২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সাইদুর রহমান বয়াতি

খ্যাতিমান শিল্পী ও গীতিকার সাইদুর রহমান বয়াতি পেয়েছেন বাংলা একাডেমির ফেলোশিপ, শিল্পকলা একাডেমির পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার -

খ্যাতিমান শিল্পী ও গীতিকার সাইদুর রহমান বয়াতি। দেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতির বিভিন্ন আঙ্গিকের অন্যতম পালাকার, নির্দেশক এবং অভিনেতা। এগুলো ছাপিয়ে তার অন্যতম পরিচয় তিনি একজন মরমী সাধক। ৮৮ বছর বয়সেও তার চোখেমুখে এক উজ্জ্বল দ্যুতি, কণ্ঠে তারুণ্যের ছাপ। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, মারফতি, কবিগান, রাখালিয়া, গাজীর গানসহ প্রায় ৫০ রকমের গান জানেন তিনি। গান লিখেছেন দুই হাজারের বেশি। সঙ্গীতে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, শিল্পকলা একাডেমি পদকসহ একাধিক সম্মাননা লাভ করেছেন।
ব্যক্তিজীবন ও পেশা : ১৯৩১ সালে মানিকগঞ্জের পুটাইল ইউনিয়নের হাসলি গ্রামে জন্ম সাঈদুর রহমান বয়াতির। বাবা জিগির আলীও ছিলেন গানপাগল মানুষ। বাবার সাথে ছোটবেলা থেকেই দোতরা বাজিয়ে গান গাইতেন। কবে যে নামের পেছনে বয়াতি বিশেষণটি যোগ হয়েছে তা নিজেও জানেন না। ৮৮ বছর বয়সে আজো কর্মঠ। ১৫ বছর বয়স থেকে গান লেখা শুরু। এরপর থেকে তিনি নতুন নতুন গান, সুর সবই করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। মাতা কুসুমী বেগম ছেলের গানে মুগ্ধ হয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। ১৯৫৯ সালে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে অংকে ফেল করার পর আর পরীক্ষা দেননি। এই কবি গায়কের নেশা ও পেশা মিলেমিশে একাকার। গানের আনন্দ ভুবনের মধ্যে থেকেই তিনি জীবিকার সন্ধান করেছেন। গান গেয়ে যে সামান্য অর্থ পেয়েছেন তা দিয়েই কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালিয়েছেন। জীবন চালিয়েছেন গান গেয়ে ও ৮০ টাকার সঞ্চয় দিয়ে মুদি দোকান করে। বিভিন্ন সময় গানের দল গঠন করেছেন। মতের মিল না হলে দল ভেঙেছেন। আবার দল গঠন করেছেন। এখনো একটি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। রেডিও-টেলিভিশনেও তার গানের অনুষ্ঠান প্রচার হয়েছে। লোকসঙ্গীত সাধনার পাশাপাশি ব্যস্ত দেশের লোকসংস্কৃতির নানা বিষয় সংগ্রহ, লোক সংস্কৃতি, লোকসঙ্গীত, বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কিত বিভিন্ন সেমিনার, রেডিও-টিভির টকশো সেমিনারেও আলোচক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। অধ্যাত্ম সাধনার পাশাপাশি পড়ছেনও প্রচুর। তিনি লোকসঙ্গীতে বাংলা একাডেমির ফেলোশিপও পেয়েছেন।
গানের আসর থেকে স্কুলে : গানপাগল এ মানুষটি কিভাবে শিক্ষাদীক্ষার সংস্পর্শে এলেন, জানালেন তিনিÑ ‘তখনকার দিনে চৈত্র-বৈশাখ মাসে বৃষ্টির আশায় মানিকগঞ্জে মেয়েদের কণ্ঠে সারিগান গাওয়ার প্রচলন ছিল। একবার পরিবারের সবাই মিলে বৃষ্টির প্রত্যাশায় গান করছিলাম। সেই দলে আমার মা, চাচী ও প্রতিবেশী অনেকেই ছিলেন। আমি বুক চাপড়ে সারিগান করছিলাম। গান গাওয়ার একপর্যায়ে আচমকা একজন আমাকে কান ধরে টেনে তুললেন। তাকিয়ে দেখি তিনি আমার ভগ্নিপতিÑ ইয়াসিন আলী। পশ্চিম হাসলি স্কুলের মাস্টার। তিনি আমাকে স্কুলে নিয়ে ভর্তি করে দিলেন। ১৪-১৫ বছরের সময় ইয়াসিন মাস্টার জোর করে ভর্তি করে দেন মানিকগঞ্জের পশ্চিম হাসলি ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময়ই ক’জন প্রতিবেশীর সাথে হেঁটে ১৯৫১ সালে জিন্নাহ সাহেবকে দেখতে ঢাকায় গিয়েছিলাম। তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে জিন্নাহকে একটি স্মারকলিপি দিয়েছিলেন। তখন একটি গান লিখেছিলামÑ ‘আমার ভাষায় বলব কথা। তোদের কেন মাথাব্যথা, এই ভাষাতে জুড়ায় প্রাণ, তোদের কি তাতে যায়রে মান?’ এটাই প্রথম লেখা গান। সেই থেকে গান লেখা ও নিজের গানে সুর দেয়ায় অবিরাম যাত্রা। প্রাইমারি স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে ভর্তি হলাম নবগ্রাম হাইস্কুলে। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় লজিং থাকতাম নবগ্রামের জহির বয়াতির বাড়ি। জহির বয়াতি একজন গুণীশিল্পী। আমাকে খুব পছন্দ করতেন। তার কাছে গানের পাশাপাশি সারিন্দা, দোতরা, বায়া, খঞ্জনি বাজাতে শিখেছিলাম। প্রতিদিন তালিম নিতাম। এর মধ্যে দেশে ভাষা আন্দোলন শুরু হলো।
ভাষা আন্দোলনে যুক্ত : আমার ভাষায় বলব কথা/তোদের কেন মাথা ব্যথা/এই ভাষাতে জুড়ায় প্রাণ/তোদের কি তাতে যায়রে মান?
১৯৫২ সাল। মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার নিয়ে সারা বাংলায় মানুষ তখন টগবগ করে ফুটছে। মানিকগঞ্জে নিভৃত পল্লীর এক কিশোর সাইদুর রহমানের মনেও তা আন্দোলিত হয়। তারই প্রকাশ ঘটিয়ে এই কবিতা লেখা। এই গান তিনি বিভিন্ন আসরে, বাজারে গেয়ে বেড়াতেন। তিনি বলেন, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে, তখনো আমি গান গেয়েছি। মানুষকে ন্যায্য আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছি। ভাষা সংগ্রামী রফিক শহীদ হওয়ার পর আমি তাকে নিয়ে একটি গান রচনা করি। গানটির কথা ছিলÑ ‘মারিস না মারিস না ওরে, মারিস না বাঙ্গাল/এ দেশ ছেড়ে পালাবি তোরা, পালাবে না এই বাঙ্গাল।’
শেরেবাংলা, ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুকে গান শুনিয়েছেন : ১৯৫৪ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের এক জনসভায় তাকে গান গেয়ে শুনিয়েছেন। একবার মানিকগঞ্জের এক জনসভায় মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর উপস্থিতিতেও গান গাওয়ার সুযোগ হয়। মওলানা সাহেব আবেগাপ্লুত হয়ে দোয়া করেছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান ও ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে ভোটের গান গেয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুকে দরবার হলে এক সংবর্ধনা দেয়া হয়। ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের খেলা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর বাংলার দুধের সর, সে বিনে বাঁচে না এই বাংলার প্রাণ’Ñ গান গেয়ে শোনান। এই গান শুনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে একটি কেমি ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন।
রেডিওতে গাইতে শুরু : স্বাধীনতার বেশ আগে পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের সাথে পরিচয় হয়। বড়ই দিলখোলা মানুষ তিনি। উচ্চশিক্ষিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার। মানুষটি শিল্পীদের খুব ভালোবাসতেন। তিনি তার গান শুনে খুব পছন্দ করলেন। একদিন তাকে নিয়ে গেলেন নাজিমউদ্দিন রোডে, রেডিও সেন্টারে। গান গাওয়ার ব্যবস্থা হলো। তখন থেকে নিয়মিত রেডিওতে গান করছেন। সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আজম খান তার রচিত গানের একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার ছেলেকে নিয়ে একদিন টেলিভিশন সেন্টারে গেলেন। সে শিশুশিল্পী হিসেবে টেলিভিশনে গান গাইবে, কিন্তু তারা তাকেও গান গাইতে বললেন। এরপর মুস্তাফা জামান আব্বাসীর উপস্থাপনায় ‘ভরা নদীর বাঁকে’ ও ‘হিজল তমাল’ অনুষ্ঠানে নিয়মিত গান করেছেন।
চলচ্চিত্রে অভিনয় : তিনি গানপাগল মানুষ। গান রক্তে মিশে আছে। গান গাইতে গাইতে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন। ‘নদীর নাম মধুমতি’, ‘লালসালু’, ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’, ‘লালন’, ‘লিলিপুটেরা বড় হবে’সহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। ‘নদীর নাম মধুমতি’তে গান গেয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। আসলে শিল্পীদের কোনো নির্দিষ্ট পেশা থাকে না। তারা তো অন্য রকম মানুষ। জগতের মোহ তাদের স্পর্শ করে না। গুণী এই বাউল সাধক ২০১২ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পদক।
মানুষ এখন নিজেকে ছাড়া কাউকে চেনে না। তাদের সতর্ক করে বলেছেন, ‘আমি যোগ পূরণের লাভ বুঝি না/ভাগ বিয়োগেই ধন্য। জীবন খাতায় অঙ্ক কষে/ ফল পেয়েছি শূন্য।’ শেষ বয়সে এসে এই আত্মোপলব্ধি থেকে তিনি সবার কাছে আবেদন রেখেছেন, অর্থবিত্তের মায়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে মানুষের জন্য কিছু একটা করার চেষ্টাই শ্রেয়। লোকসঙ্গীত সাধনার পাশাপাশি ব্যস্ত দেশের লোকসংস্কৃতির নানা বিষয় সংগ্রহ, লোকসংস্কৃতি, লোকসঙ্গীত, বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কিত বিভিন্ন সেমিনার, রেডিও-টিভির টকশো সেমিনারেও আলোচক হিসেবে রয়েছে তার খ্যাতি।


আরো সংবাদ



premium cement