১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মা, কথা বলো

চারাগল্প
-


রাশেদের মন খুব খারাপ। ওর বাবা আর মা প্রতিদিন ঝগড়া করে।
সকাল, বিকেল, রাতÑ যেকোনো এক সময় ঝগড়া লাগবেই। রাশেদের বয়স সবে পাঁচ বছর চলছে। শাহিন আর রাশেদার বিয়ে হয়েছে ১০ বছর আগে। বিয়ের আগে চুটিয়ে প্রেম করেছে।
এক সময় দুই পরিবার মেনে না নেয়ায় বাড়ি থেকে পালিয়ে দূরের কোথাও গিয়ে নিজেদের মতো করে বিয়ে করে শাহিন ও রাশেদা।
অবশ্য বিয়ের কয় মাস পর দুই পরিবার বাধ্য হয়ে মেনে নেয় দু’জনকেই।
বিয়ের আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে আর ফেসবুক চ্যাটিংয়ে কথা বলত শাহিন ও রাশেদা।
একই উপজেলায় বাড়ি ওদের, কী যেন একটা কাজে রাশেদার কলেজে গিয়েছিল শাহিন।
কলেজ ক্যাম্পাসে প্রথম দেখাতেই রাশেদার প্রেমে পড়ে শাহিন।
সেদিনের পর থেকে নিয়ম করে মোটরবাইক নিয়ে রাশেদার কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত শাহিন।
মেয়েদের চোখ নাকি শকুনের চোখ! ওদের মন নাকি জ্যোতিষীর মতো। একটা ছেলের চোখের দিকে একনজর তাকালে নাকি তার মনের কথা বুঝতে পারে।
একদিন শাহিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আগবাড়িয়ে কথা বলে রাশেদা।
সেদিনের পর থেকে ধীরে ধীরে একজন আরেকজনের প্রেমে পড়ে যায়।

দুই.
বিয়ের আগে যে স্বপ্ন দেখাত শাহিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা রঙিন স্বপ্ন বুনত। রাশেদার বুকের আকাশ জুড়ে উড়িয়ে ছিল সুখের পায়রা।
বিয়ের পরে বাস্তব জীবনে আজ সেই রাশেদার দিন কাটে কান্না করে।
এক সময় যে শাহিন বলত, আমাদের একটা ছোট্ট সংসার হবে। আমাদের ঘর আলোকিত করতে তোমার কোলজুড়ে আসবে এক ছোট্ট রাজকুমার। আজ সেসব মধুমাখা কথা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে!
রাশেদার মনের বারান্দায় খেলা করে অতীত স্মৃতি।
আজ যদিও রাশেদার কোলজুড়ে এক মিষ্টি রাজকুমার আছে। তবে শাহিনের সেই অতীত কথা আর স্বপ্নময় দিনগুলো নেই।
অতীত স্মৃতি মনে পড়তেই রাশেদার দু’চোখে শ্রাবণের বর্ষা নামে।
হঠাৎ কোথা থেকে যেন দৌড়ে মায়ের কাছে চলে আসে রাশেদার এক মাত্র আদরের দুলাল রাশেদ।
মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে বায়না ধরে, বাবার সাথে হাটে যাবে।
আজ শুক্রবার, দুর্গাপুরের হাট।
রাশেদের খেলার সাথী রাফি, তানফিÑ ওরাও আজ ওদের বাবার সাথে হাটে যাবে।
কত রকম মজার খাবার ওঠে হাটে! সাপের খেলা আর নানা রকম খেলনা জিনিসের মেলাও বসে দুর্গাপুরের স্কুলমাঠে।
রাশেদ মায়ের আঁচল ধরে কান্দে আর বলে, মা আজ আমিও হাটে যাবো। বাবা এলে বলো কিন্তু।
দুপুর থেকে নতুন জামা পরে আছে রাশেদ।
দৌড়ে একবার পুকুরপাড়ে যায় আবার বাড়ি চলে আসে, অপেক্ষা বাবার জন্য। দেখতে দেখতে সন্ধ্যার একটু আগে বাড়ি আসে শাহিন।
বাবাকে দেখে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বায়না ধরে বলে, বাবা আজ আমিও তোমার সাথে হাটে যাবো।
একঝটকায় রাশেদের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় শাহিন।

তিন.
দুই দিন আগে রাশেদার সাথে প্রচণ্ড ঝগড়া করে শাহিন এবং গায়ে হাত তোলে। এক সময় রাশেদার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে, জোর করে গরু বিক্রি করে শাহিন।
এ কারণে আজ দুই দিন ধরে কথা বলা বন্ধ দু’জনের মধ্যে।
বাবার কাছে কথার উত্তর না পেয়ে, আবার মায়ের কাছে যায় রাশেদ।
মায়ের মুখে হাত দিয়ে আদর করতে করতে বলেÑ ওমা, মা...। বাবার কাছে বলো আমিও হাটে যাবো।
ছেলের কথা শুনে এক সময় শাহিনের কাছে গিয়ে ছেলের বায়নার কথা বলে।
জুয়ায় হেরে মন-মেজাজ একদম ঠিক ছিল না শাহিনের।
রাশেদার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে প্রচণ্ড মাইর দেয়।
দুই দিন ধরে ঠিকমতো খাবার না খাওয়ায় এবং অতিরিক্ত মাইরের কারণে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রাশেদা।
বাবার এমন আচরণে ভয়ে আঁতকে ওঠে ছোট্ট রাশেদ।
এক সময় হাতে একটা সিগারেট ধরিয়ে সুখটান দিতে দিতে বাইরে চলে যায় শাহিন।
মা, মা... বলে চিৎকার দিয়ে কান্না করে রাশেদ।
মায়ের হাত ধরে টান দেয়, কপালে গালে চুমু খায়, আদর করে।
কান্নাভেজা চোখে বারবার বলে, মা আমি আর কখনোই হাটে যেতে চাইব না।
এবার তুমি ওঠো মা...!
মা, এই মা, মা গো... আরে কথা বলো মা!
এক সময় রাত গভীর হয়, রাতের আকাশে হঠাৎ করে বিজলি চমকায়!
রাশেদার টিনের চালে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে।
বৃষ্টির শব্দে হারিয়ে যায় রাশেদের কান্না!
রাশেদার নিথর দেহ পড়ে থাকে ঘরের মেঝেজুড়ে।
আর রাশেদ তখনো বলে চলছে... মা, এই মা, আরে ওঠো না মা প্লিজ... আমি আর কোনো দিনও হাটে যেতে চাইব না। মা, মাগো, ও মা, মা কথা বলো।
দুর্গাপুর, কুড়িগ্রাম

 


আরো সংবাদ



premium cement