২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

উড়ে যায় বকপক্ষী

চারাগল্প
-


আসমা এবার বার্ষিক পরীক্ষায় পুরো স্কুলজুড়ে প্রথম হয়েছে। এ আনন্দ যতটা না আসমার বাবা-মায়ের, ততটা মিজানেরও। কারণ, মিজানের কাছে প্রাইভেট পড়ে আসমা আরো বেশি বিদ্বান হয়েছে। ১০ দশ মাস ধরে এই বাড়িতে টিউশনি করছে মিজান। মাস শেষে আসমার বাবা কবির সাহেব মিজানের হাতে মাইনে তুলে দেন।
আসমা ছাড়াও আরো ছয়টি টিউশনি করে মিজান। টিউশনিগুলোর ভালো মাইনে দিয়ে মিজানের সংসার ভালো চলে। স্ত্রী ফারিয়াকে নিয়ে ছোট্ট সংসার। ছয় মাস আগে ফারিয়া মা হয়েছে। কন্যাসন্তান মিম পৃথিবীতে আসার পর আরো দায়িত্ব বেড়েছে মিজানের। বাবা-মাহারা এতিম মিজানকে জীবন দিয়ে ভালোবাসে ফারিয়া।
২.
আসমাদের এখন দারুণ অভাব চলছে। ফলে কবির সাহেব গত তিন মাস বেতন দিতে পারেননি মিজানকে। এ নিয়ে মিজানের দুঃখ নেই। তিন মাসের বেতন বাকি পড়ে থাকলেও মিজান ঠিকই রোজ বিকেলে চারতলার সিঁড়ি বেয়ে আসমাদের বাসায় এসে আসমাকে পড়িয়েছে। আসমার মা ঝরনা বেগম মাঝে মধ্যে মিজানের জন্য নাশতা পাঠালেও তিন মাস ধরে তিনি নীরব ছিলেন। বেচারীর তো কিচ্ছু করার ছিল না। সংসারে অভাব দেখা দিলে এমন হয়। কবির সাহেবের অফিসে কী নিয়ে যেন গণ্ডগোল। মালিক বেতন দিচ্ছেন না। তত দিনে আসমারও বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তিন মাসের টিউশনির বেতন আটকে গেল।

৩.
মিমকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। জ্বরের পাশাপাশি শ্বাসকষ্টও বেড়েছে। ডাক্তারের নির্দেশমতো মিজান মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে।
টাকার খুব দরকার। হাসপাতাল মানেই মোটা অঙ্কের টাকা। এতটুকু বাচ্চা, অথচ নানান টেস্টের পেছনে লম্বা খরচ হতে হতে মিজানের এখন টানাপড়েন। কবির সাহেব তিন মাসের বেতন যদি দিতেন, চাপ না হয় কিছুটা কমত। সেই আশায় কবির সাহেবকে ফোন দেয় মিজান। কিন্তু নাম্বার বন্ধ। কবির সাহেবের নাম্বার বন্ধ দেখে মিজান ভাবে, আসমাদের বাসায় গেলে কেমন হয়! এত দিনে নিশ্চয়ই ওর বাবা চাকরির টাকা পেয়ে গেছেন।
আবারো কল দেয় কবির সাহেবকে। এবার নাম্বার খোলা। রিসিভ করেন কবির সাহেব। মিজান অনুনয়ের সুরে বলেÑ ‘আঙ্কেল, টাকার কি কোনো ব্যবস্থা করা যায় না? আমার মেয়ের খুব অসুুখ।’ কবির সাহেব আশ্বাস দিয়ে বলেনÑ ‘তুমি আগামী শুক্রবার এসো বাবা।’
মন খারাপ হয় মিজানের। শুক্রবার যাওয়াটা ব্যাপার নয়; কিন্তু টাকাটা দরকার এখন। শুক্রবার আসতে আরো ছয় দিন বাকি। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে মিজানের।
৪.
টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। মিজান তার বন্ধু সফিকের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা ধার নিয়ে হাসপাতাল থেকে মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফেরে।
আজ শুক্রবার। আসমাদের বাসায় গিয়ে টাকা আনার কথা থাকলেও আজ মিজানের যাওয়া হবে না। কারণ, তার গা কাঁপানো জ্বর। বিছানায় শয্যাশায়ী হয় সে। ফারিয়া উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। স্বামীর সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়।
চার দিনের মাথায় সুস্থ হয় মিজান। আজ মঙ্গলবার। বিকেলে আসমাদের বাসায় রওনা দেয় সে। তিন মাসের বেতন আজ একসাথে পাবে বলে মনে মনে খুশি মিজান।
বাসার কলিংবেল দ্বিতীয়বার চাপার পর দরজা খোলেন অচেনা এক মাঝবয়সের ভদ্রলোক। আসমাদের বাসায় এই ভদ্রলোককে আগে কখনো দেখেছে বলে মিজানের মনে পড়ে না।
Ñকাকে চাই?
Ñইয়ে... আমি আসমার টিচার।
Ñআসমা?
Ñহ্যাঁ। কবির আঙ্কেলের মেয়ে আসমা।
Ñওহ। জনাব কবির সাহেব তো চার দিন আগে এই বাসা ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা নতুন ভাড়াটিয়া।
Ñমানে? কী বলছেন? কোথায় গেছেন?
Ñতা জানি না।
৫.
ব্যস্ত শহরের ধূলিমাখা পথে এলোমেলো হাঁটছে মিজান। কবির সাহেব তার সাথে খুব খারাপ আচরণ করেছেন। প্রাপ্য বেতন না দিয়ে এভাবে গা-ঢাকা দেয়ার মানে কি? মিজান ফোন বের করে কবির সাহেবের নাম্বারে ডায়াল করে। কিন্তু নাম্বার বন্ধ।
তিন মাসের বেতনের কথা ভাবতেই চোখ ভিজে আসে মিজানের। চোখ মুছে সে আকাশের দিকে তাকায়। দুটো বক পাখি উড়ে যেতে যেতে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঠিক আসমাদের মতো।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী


আরো সংবাদ



premium cement