২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ফুলের গন্ধে ঘুম আসেনা

চারাগল্প
-

রাবেয়ার দুঃখ একটাই, সে কখনো ঢাকা শহর দেখেনি। ঢাকা থেকে আব্বা যখন ছুটিতে বাড়ি আসেন, রাবেয়া কৌতূহলী কণ্ঠে আব্বার কাছে ঢাকার গল্প শোনার আবদার তোলে। আব্বাও কোনো রকম বিরক্ত না হয়ে রাবেয়াকে জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, সংসদ ভবন, শহীদ মিনার ও বাংলা একাডেমির গল্প শোনান। সেসব গল্প শুনে রাবেয়া নিরসগলায় বলেÑ ‘ইস, কবে যে ওসব দেখব।’
রাবেয়া আমার ছোট বোন। এবার ফাইভে পড়ে। ওর একটা রোগ আছে। থ্যালাসেমিয়া। প্রতি মাসে রক্ত দেয়া লাগে। আম্মা প্রায়ই রাবেয়াকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলেন, ‘আমার এত সুন্দর মেয়েটার কেন যে এই রোগ হলো!’ রাবেয়া আশ্চর্য রকম সুন্দর রূপ নিয়ে যেদিন জন্মেছে, সেদিন বড় আপা বললেন, ‘ওর নাম রাখব রুপা।’ ডালিমতলায় বোয়াল মাছ কুটতে কুটতে দাদী বললেন, ‘না। আমার নাতনীর নাম হবে রাবেয়া।’
রাবেয়া বড় হতে থাকে। ফুলগাছের প্রতি ওর দারুণ ঝোঁক। আমাদের ছোট্ট বাড়িতে জায়গার অভাব বলে ফুলের চারা না লাগাতে পেরে ওর মন খুব খারাপ হয়। যদিও পশ্চিমের জানালার পাশে একটা গন্ধরাজ ফুলের গাছ লাগিয়েছে সে।
২.
পড়ালেখার জন্য আমিও ঢাকায় আব্বার কাছে চলে আসি এক সময়। মাস শেষে বাড়ি যাই। ফিরে আসার সময় রাবেয়া মন খারাপ করে। সে কখনো ঢাকা দেখেনি। আমার সাথে ঢাকায় আসতে ওর কত আবদার! আমি সে আবদার রাখতে পারি না। শুধু কথাই দেইÑ ‘তোকে একদিন ঢাকায় নিয়ে যাবো। দেখিস।’ আনন্দে রাবেয়ার চোখ চকচক করে ওঠে। মনে মনে প্রতীক্ষার প্রহর গোনে সেই কাক্সিক্ষত সময়ের।
৩.
এবার মাস শেষে আমি আর আব্বা একসাথে বাড়ি এসেছি। ঢাকাকে ঘিরে এবার রাবেয়ার কৌতূহল নেই। থ্যালাসেমিয়া রোগ ওকে নিস্তেজ করে দিয়েছে। ক’দিন আগে শরীরে রক্ত দেয়া হয়েছে; কিন্তু এবার উন্নতি হচ্ছে না। অথচ এমন হওয়ার কথা ছিল না।
হাসপাতালে আনা হলো রাবেয়াকে। ডাক্তার আমাকে আর আব্বাকে জানালেন, ‘রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। ঢাকায় নিতে হবে।’ আমরা চুপ থাকি না। চুপ থাকার সময়ও না। রাবেয়া নুয়ে পড়ে যাচ্ছে। কোনো কথা বলছে না।
অ্যাম্বুলেন্সে বসে আছি আমি আব্বা আর রাবেয়া। রাবেয়া চোখ বন্ধ করে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে আমার কোলে। আজ সে ঢাকায় যাচ্ছে। অথচ ওর মধ্যে সেই ভাবান্তর নেই।
কাঁচপুর ব্রিজের মাঝখানে আসতেই রাবেয়া বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়ল। তারপর আস্তে চোখ বন্ধ করে ফেলল। বুকটা ধক করে উঠল আমার। আব্বা রাবেয়ার বুকে কান রাখেন। না, নিঃশ্বাস ওঠানামার আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। আমি চিৎকার দিলামÑ ‘রাবু, এই রাবু, চোখ খোল। দেখ আমরা ঢাকার কাছাকাছি।’ না, রাবেয়ার সাড়াশব্দ নেই। আব্বা বললেন, ‘তুই থাম তো। কিচ্ছু হয়নি। এই ড্রাইভার, জোরে চালাও।’ আব্বার গলা কাঁপছে। কান্নায় নাকি আতঙ্কে, বুঝতে পারছি না।
অ্যাম্বুলেন্স উল্কার মতো ছুটছে। যাত্রাবাড়ীর স্থানীয় এক ক্লিনিকে নিয়ে গেলাম রাবেয়াকে। ডাক্তার রাবেয়াকে দেখলেন। নিরসগলায় বললেন, ‘মেয়েটা বেঁচে নেই।’ আব্বা চিৎকার দিলেন। হাসপাতাল কাঁপিয়ে আমার কান্না আসছে। আমাদের রাবেয়া মরে গেছে!
আমরা যেই অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় এসেছি, সেই অ্যাম্বুলেন্সে করেই বাড়ি যাচ্ছি। চিরনিদ্রায় অ্যাম্বুলেন্সের সিটে শুয়ে আছে রাবেয়া। ওর ঢাকায় আসার খুব শখ ছিল। আজ ঢাকায় এসেছে, কিন্তু ঢাকা দেখতে পারেনি। আব্বা হাউমাউ করে কাঁদছেন।
৪.
পুকুরপাড়ে কবর দেয়া হলো রাবেয়াকে। আমাদের সারা বাড়িতে তরতাজা শোক। আম্মা সারা দিন পাটিতে বসে কোরআন পাঠ করেন। আব্বা পুকুরঘাটে চেয়ারে বসে রাবেয়ার কবরের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলেন।
এখন মধ্যরাত। হেমন্তের রুপালি রাতে জোনাকিরা সারা বাড়ি জ্বলছে। জোনাকিরা কী পুকুরপাড়েও রাবেয়ার কবরের পাশে জ্বলছে! সেটা দেখতে পশ্চিমের জানালাটা খুলে দিতেই কিসের এক ফুলের গন্ধ নাকে এলো। দেখি জানালার পাশে রাবেয়া যে গন্ধরাজ গাছটি লাগিয়েছিল, এই হেমন্তে তাতে ফুল এসেছে। ফুলের গন্ধে সারা বাড়ি ভেসে যাচ্ছে। গন্ধরাজ ফুলের ঘ্রাণ এত দারুণ কেন! না, এই ঘ্রাণ যত দারুণই হোক, কাল সকালে এ গাছটি কেটে ফেলব। গন্ধরাজ যতই ঘ্রাণ ছড়াবে, ততই আমার রাবেয়াকে মনে পড়বে। আমি ঘুমাতে পারব না।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী


আরো সংবাদ



premium cement