২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

পুরান ঢাকার বাকরখানি

-

ঐতিহ্যবাহী খাবারের জন্য পুরান ঢাকার নাম উঠে আসে সবার আগে। আর পুরান ঢাকার এক-একটি খাবার বিখ্যাত হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে আলাদা আলাদা ঐতিহ্য। পুরান ঢাকার নানা স্বাদীয় খাবারের তালিকায় বাকরখানিও রয়েছে। রুটিজাতীয় একটি সুস্বাদু ও ঐতিহ্যবাহী খাবার এটি। রুটিজাতীয় এ খাবারটি ছোট-বড় সবার কাছেই অতিপ্রিয়। পুরান ঢাকাবাসীর নাশতার খাবারে বাকরখানি অন্যতম। অতিথি আপ্যায়নে বাকরখানির স্থান প্রথম।
ময়দা, ডালডা, দুধ, লবণ, চিনি ও পানির মিশ্রণে বাকরখানি তৈরিতে এক সময় খাঁটি ঘিও ব্যবহৃত হতো বলে জানা যায়। পুরান ঢাকার সব এলাকায়ই কম-বেশি রয়েছে বাকরখানির দোকান। এসব এলাকা দিয়ে হেঁটে কিংবা রিকশায় চলার সময় রাস্তার দুইপাশে চোখে পড়বে ছোট দোকানগুলোতে বাকরখানি তৈরি ও বিক্রির ধুম। দোকানগুলো থেকে নাকে ভেসে আসবে বাকরখানি ভাজার ঘ্রাণ। অন্য যেকোনো পণ্যের দোকানগুলো পরিপাটি করে সাজানো হলেও বাকরখানি তৈরির দোকানগুলোতে তেমন নান্দনিকতা চোখে পড়ে না। এমনকি কোনো সাইনবোর্র্ডও নেই। চুলার কালো কালিতে সাইনবোর্ড নাকি ক’দিন পরই ঝলসে যায়, যে কারণে দোকানিরা সাইনবোর্ড লাগানোর প্রয়োজন মনে করেন না।
বাকরখানি তৈরিতে তেমন লোকবলেরও প্রয়োজন হয় না। তিনজন কারিগর হলেই তৈরি করা যায় বাকরখানি। একজন খামির তৈরি করে দেবেন, একজন খামির বেলে দেবেন আর একজন রুটি ছ্যাঁকা দিলেই হয়ে গেল গরম গরম বাকরখানি। প্রথমে তৈরিকৃত খামির থেকে কেটে ছোট ছোট বল তৈরি করতে হবে। এবার বলটিকে বেলুনের সাহায্যে পিঁড়ির ওপর সমান্তরালভাবে ছোট গোলাকার কাঁচা রুটি তৈরি করতে হয়।
কাঁচা রুটির মাঝখানে চাকু দিয়ে লম্বা করে তিন-চারটি দাগ কেটে দেয়া হয়, যাতে রুটি ফুলে না যায়। এবার এর এক পাশে পানির সামান্য প্রলেপ দিয়ে তন্দুরের দেয়ালে আটকে দেয়া হয়। ৫ থেকে ৭ মিনিট গরম কয়লার তাপে তৈরি হয়ে যায় বাকরখানি। তারপর লম্বা দু’টি শিক দিয়ে বিশেষ কায়দায় তন্দুর থেকে উঠানো হয় মচমচে বাকরখানি।
একসময় আমাদের দেশে এক ধরনের বাকরখানি তৈরি হলেও এখন চাহিদা অনুযায়ী তৈরি হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের বাকরখানি। লবণাক্ত ও মিষ্টিÑ দুই ধরনের বাকরখানি তৈরি হচ্ছে।
রাজধানীতে ফাস্টফুডের দোকানগুলোতে বাহারি খাবারের লম্বা তালিকা থাকলেও বাকরখানির চাহিদা একটুও কমেনি, বরং চার দিকে যখন ভেজাল খাবারে বাজার সয়লাব; তখনো দাপটের সাথে চলছে বাকরখানি।
যুগ যুগ ধরে বাকরখানির দোকানগুলো টিকে রয়েছে। বিশেষ করে ইসলামবাগ, হাজারীবাগ, লালবাগ, নাজিরাবাজার, চকবাজার, আবুল হাসনাত রোড, আগা সাদেক রোড, বংশাল, সিদ্দিকবাজার, বনগ্রাম, ওয়ারী, মৈশণ্ডি, লক্ষ্মীবাজার, একরামপুর, সূত্রাপুর, গেণ্ডারিয়া, নারিন্দা, দয়াগঞ্জ, বাসাবোÑ এক কথায় পুরান ঢাকার সর্বত্রই বাকরখানির দোকান নজরে পড়ে। পুরান ঢাকার সীমানা পেরিয়ে ধানমন্ডি, গুলশান ও বনানীর মতো অভিজাত এলাকায়ও পাওয়া যাচ্ছে বাকরখানি। শুধু তাই নয়, রাজধানীর আশপাশের জেলা নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর ও ঢাকার দোহার, নবাবগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, সাভার ও ধামরাইতে গড়ে উঠেছে বাকরখানি তৈরির দোকান। এসব দোকানে বিক্রিও বেশ ভালো। পুরান ঢাকায় হাজারো পরিবারের লোক আছেন, যারা বংশপরম্পরায় বাকরখানির কারিগর হিসেবে কাজ করছেন। প্রতি কেজি বাকরখানি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা।
নারিন্দা এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা সৈয়দ মাহতাব আলী তপু জানান, প্রতিদিন সকাল-বিকেলে নাশতা হিসেবে বাকরখানি থাকতেই হবে। বাকরখানি ছাড়া আমাদের নাশতা চলে না। অতিথি আপ্যায়নে বাকরখানির প্রচলন রয়েছে।
ঢাকার ধোলাই খালের বাকরখানি ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম জানান, এ এলাকার মানুষের কাছে বাকরখানি প্রসিদ্ধ খাবার। চাহিদা থাকায় প্রতিদিন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে।
ঢাকার নবাবগঞ্জের যন্ত্রাইল এলাকার বাকরখানি ব্যবসায়ী আব্দুল মানান জানান, ছোটবেলায় শিখেছি। এরপর থেকে এই ব্যবসায়ের সাথে আছি। একসময় বাকরখানি তৈরি করে লাভ বেশি হতো। বাকরখানির দাম তুলনামূলক না বাড়লেও বেড়ে চলেছে এটি তৈরির উপকরণ; যার জন্য কোনো রকম খেয়ে-পরে বেঁচে আছি।
পুরনো কালের ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাকরখানি তৈরির পেছনে রয়েছে অমর প্রেমকাহিনী। আগা বাকের নামে তুর্কিস্তানের এক ভাগ্যবিড়ম্বিত বালক ক্রীতদাস হয়ে এসেছিল এ দেশে। বাংলার সুবেদার নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ ক্রীতদাসরূপী সুদর্শন এ বালকটিকে কিনে নিয়েছিলেন। আগা বাকেরের বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে নবাব তাকে লেখাপড়া ও সামরিকবিদ্যায় সুশিক্ষিত করে তোলেন। যৌবনে আগা বাকের প্রথমে চট্টগ্রামে ফৌজদারের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর দীর্ঘ সময় তিনি বাকলা চন্দ্রদ্বীপের শাসনকর্তা ছিলেন। তার নামানুসারে বাকেরগঞ্জ (পরবর্তীকালে বরিশাল) জেলার উৎপত্তি হয়।
অনেক রাজনৈতিক উত্থান-পতনের নায়ক আগা বাকেরের প্রেমকাহিনী ইতিহাসের পাতায় বহুল আলোচিত বিষয়। আগা বাকের ভালোবেসেছিলেন সুন্দরী নর্তকী খনি বেগমকে। তার প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন উজির জাহান্দার খাঁর ছেলে কোতোয়াল জয়নুল খাঁ। এই নর্তকীকে ঘিরে আগা বাকের ও জয়নুল খাঁর প্রেমকাহিনী ও দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত এ কালের মারদাঙ্গা ছায়াছবিকে হার মানায়।
সুবেদার নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ এই দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের সূত্র ধরে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে বাকেরকে বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করেছিলেন। শক্তিধর কুশলী যোদ্ধা বাঘকে হত্যা করে খাঁচা থেকে বীরদর্পে বেরিয়ে এসেছিলেন। খনি বেগমকে হরণ করে দুর্গম চন্দ্রদ্বীপের গহিনে পালিয়ে গিয়েছিলেন জয়নুল খাঁ। আগা বাকের প্রেমিকাকে উদ্ধারে রণসাজে চন্দ্রদ্বীপে উপস্থিত হলে জয়নুল খাঁ খনি বেগমকে হত্যা করে নিজে আত্মঘাতী হন।
নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ গ্রন্থে এ ঐতিহাসিক কাহিনীর বর্ণনায় বলা হয়েছে, খনি বেগমকে না পেলেও প্রেমের স্মৃতি চিরজাগরূক রাখতে আগা বাকের নতুন ধরনের শুকনো রুটি তৈরি করিয়ে নাম দিয়েছিলেন বাকের খনি। সাধারণ মানুষের উচ্চারণে যা ক্রমে ‘বাকরখানি’ হয়ে গেছে।


আরো সংবাদ



premium cement