২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অচেনা নাম্বার

জীবনের বাঁকে বাঁকে
-

ডিসেম্বর মাস। নির্বাচনী পরীক্ষা শেষ।
সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। এর মাঝে একদিন এক পড়ন্ত বিকেলে আমার ফোনে একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এলো।
আমি সাধারণত অচেনা নাম্বার থেকে কল এলে তা রিসিভ করি না। কিন্তু সেদিন কী মনে করে যেন রিসিভ করে ফেললাম।
আমি হ্যালো বলার সাথে সাথে ওপাশ থেকে কেউ লাইন কেটে দিলো। তখন ফোনের পর্দায় তাকিয়ে দেখি একটা মেসেজ এসেছে। মেসেজটিতে লিখাÑ
ঝড়ৎৎু,ডৎড়হম ঘঁসনবৎ.
কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকল ব্যাপারটা। চিন্তা করলাম, কেউ যদি ভুলে ৎিড়হম নাম্বারে কল দিয়েই থাকে, তাহলে সেটা আবার মেসেজ পাঠিয়ে বলার কী আছে। তখন আমি জবাবে মেসেজ পাঠালামÑ
কে আপনি?
অপর পাশ থেকে জবাব এলো,
: আমি ভূত যে আপনার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে।
মেসেজটা পড়ে আমি প্রচণ্ড একটা শিহরণ অনুভব করলাম। আমি আর অপেক্ষা না করে তাকে কল করে দিলাম। সে কে এটা জানার জন্য আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। সে আমার কল রিসিভ করল ঠিকই, তবে আগবাড়িয়ে নিজ থেকে কিছুই বলল না। আমি অনেকবার হ্যালো বলার পরও অপর পাশের মানুষটি পুরোপুরি চুপ করেই রইল। অতঃপর তার পরিচয় জানতে চাওয়ার পর যেন হঠাৎ করে তার মুখে কথার বুলি ফুটল। একটি ছেলে কণ্ঠ! তাকে শেষবারের মতো পরিচয় জিজ্ঞেস করে আমি যখন ফোনটা রেখে দেবো ভাবছিলাম, তখন অপর পাশের ছেলেকণ্ঠটি আমাকে আমারই পরিচয় আর ঠিকানা বলল। আমি পুরোপুরি হতবাক হয়ে গেলাম। ফোনের অপর পাশের ছেলে কণ্ঠটিকে হঠাৎ এতটাই পরিচিত মনে হলো যে, আমি ভাবতে শুরু করলামÑ আমি মানুষটাকে কত যুগ ধরে চিনি! চিন্তা করতে শুরু করলাম, এই ব্যক্তিটি কে হতে পারে, যে আমাকে এতটা ভালো করে চেনেন। একসময় আমার ভাবাভাবির অন্ত হলো এবং সে অন্তের সাথে সাথে একরাশ ভয় আমার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। আরে! এ তো আরিয়ানের কণ্ঠ! যাকে আমি এত দিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি।
আরিয়ানকে আমি প্রথম দেখি প্রায় দেড় বছর আগে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। আমার তাকে প্রথম দেখেই এত ভালো লাগল যে, এই দেড় বছরে আমি তাকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারিনি। তাই আমি কোনো প্রকার না ভেবেচিন্তেই ফোনের অপর পাশের ছেলেকণ্ঠটিকে আরিয়ান ভেবেই কথা বলতে শুরু করলাম। এভাবেই দিন কাটতে লাগল। এদিকে আমার এসএসসি পরীক্ষার দিনগুলোও ঘনিয়ে আসতে শুরু করল। তার সাথে কথা বলতে বলতে আমি বাস্তব জগৎ থেকে দূরে সরে কাল্পনিক জগতে এতটাই বিভোর ছিলাম যে, এত দিনে আমার পড়াশোনা সব লাটে উঠল। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম যে, আমি যার সাথে কথা বলছি; সে আরিয়ান ছাড়া আর কেউ নয়। তাই আর আগবাড়িয়ে কোনো দিন তার পরিচয় জানার চেষ্টা করিনি। একদিন আমি তাকে দেড় বছর আগে বিয়েবাড়িতে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা বললে, সে পুরোপুরি হতবাক হয়ে রইল। মনে হলো সে যেন কিছুই জানে না, সবই তার মাথা থেকে কর্পূরের মতো হাওয়া হয়ে গেছে। তখন আমি তাকে আবারো ঘটনাটি বললাম। ভাবলাম, হয়তো সে ভুলে গেছে, মনে করিয়ে দিতে তো আর কোনো দোষ নেই। কিন্তু এবার সে আমার পুরো কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আমাকে সে বলল, আমি কী বলছি সে তার কিছুই বুঝতে পারছে না।
আচমকা আমার মনে একটা ছোট্ট সন্দেহ উঁকি দিলো যে, আমি যার সাথে কথা বলছি, সে আরিয়ান তো?
এবার প্রথমবারের মতো আমি তার কাছে তার পরিচয় জানতে চাইলাম। আমি খুব বেশি অবাক হলাম যখন সে বলল, তার নাম অয়ন। যখন তার আসল পরিচয় জানতে পারলাম, তখন যেন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।
সে তো আরিয়ান নয়ই! এমনকি আমি তাকে চিনিও না।
পরবর্তীকালে তার কথায় জানতে পারলাম, সে আমার বড় বোনের ব্যাচে ছিল। একই সাথে পড়াশোনা করত। সে আমার আপুর কাছে যেতে চাইত। কিন্তু আপু তাকে পাত্তা দিত না, এড়িয়ে চলত।
হঠাৎ করে আমার সেদিনের কথা মনে পড়ল, যেদিন অয়ন ছেলেটির সাথে আমার প্রথম কথা হয়। মনে পড়ল সে সময়টির কথা, যখন সে আমাকে আমারই পরিচয় দিয়েছিল। মনে পড়ল সেদিন পরিচয় দেয়ার সময় আমার পরিবারের সবার নাম বললেও আমার বড় বোনের নাম বলেনি। আমি সেদিন হালকা অবাক হলেও ঠিক বুঝতে পারিনি কেন সে সেদিন আপুর নাম বলেনি।
কিন্তু আজ কিছুই বোঝার বাকি নেই। আমাকে ব্যবহার করে সে আপুর কাছে যেতে চেয়েছিল।
একমুহূর্তের জন্য সেদিন আমি আর কিছুই ভাবতে পারিনি। চোখের বাঁধ ভেঙে পানি পড়তে লাগল।
কিন্তু তবুও আমার মনে হচ্ছিল, আমি এত দিন আরিয়ানের সাথেই কথা বলেছি। নিজেকে সেদিন খুব একা মনে হচ্ছিল, খুবই অসহায় মনে হচ্ছিল।
কিন্তু এত কিছুর পরও জীবন তো আর থেমে থাকে না! এদিকে আর দুই দিন পর এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। হয়তো পরীক্ষার কারণেই সেদিন কষ্টটা কিছুটা হলেও ভুলে থাকতে পেরেছি।
এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। সেদিনের পর দীর্ঘ আট মাস চলে গেছে। রাতের পর দিন, দিনের পর দীর্ঘ নীরবতার বিকেলগুলোও চলে যাচ্ছে। সেদিনের ঘটনাটির পর আজ অনেকটাই সামলে উঠেছি আমি। কিছু জিনিসের পরিবর্তনও ঘটেছে আমার মধ্যে। সেদিনের কষ্টটা আজো অনুভব করি। তবে এখন আর আননোন নাম্বার থেকে কল এলে আগের মতো রিজেক্ট করি না। রিসিভ করি, হয়তো কোনো একটি পরিচিত কণ্ঠ শোনার জন্য।
আমার জীবনের প্রায় সবই বদলে গেছে। শুধু একটি নিয়মই বদলায়নি। হাজার ব্যস্ততার মাঝেও প্রত্যেক বিকেলে অদ্ভুত অস্থিরতা নিয়ে শান্ত চোখে আকাশের মেঘ দেখি। এক ধরনের অসহ্যকর নীরবতা আমাকে ঘিরে রাখে। তবুও ফোনের পর্দায় তাকাতে ভুলি না।
হয়তো কোনো একদিন সুনসান নীরবতায় মাখা এক বিকেলে কোনো এক অচেনা নাম্বার থেকে কল আসবে এবং ফোনের অপর পাশ থেকে একটি ছেলেকণ্ঠ ভেসে আসবে।
ছেলেকণ্ঠটি বলে উঠবে,
‘হ্যালো! আমি আরিয়ান’।
আছি একটিবার তার কণ্ঠস্বর শোনার প্রতীক্ষায়।
টমছমব্রিজ, কুমিল্লা


আরো সংবাদ



premium cement