১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অন্তর্ধান

চারাগল্প
-

দাম্পত্য জীবনে শাহানা চৌধুরী একজন সুখী মানুষ। বয়স চল্লিশ পেরিয়ে। এই বয়সেও তিনি বেশ আধুনিক। ফেসবুক দারুণ উপভোগ করেন। সাড়ে চার বছর আগে মেয়ে নাবিলা তাকে ফেসবুক আইডি খুলে দিয়েছে। তখন থেকেই আবিরের সাথে ফেসবুকে ভালো সম্পর্ক শাহানা চৌধুরীর। ছেলে হিসেবে আবিরকে যথেষ্ট পছন্দও তার। অবশ্য সৎ ছেলে আবিরকে পছন্দ না করার উপায় নেই কারো। দীর্ঘ দিনের মেসেজ আদান-প্রদানের মাধ্যমে শাহানা চৌধুরী বুঝতে পারেন ছেলে হিসেবে আবির যথেষ্ট অমায়িক। ফেসবুকে তিনি যখন যা পোস্ট করেন, আবিরের সবখানে লাইক কমেন্টে উপস্থিতি থাকে। দিনে দিনে দু’জনের সম্পর্ক আন্তরিক হয়ে ওঠে। আবিরের ধারণা শাহানা চৌধুরীর চেহারা তার ফুপুর মতো। শাহানা চৌধুরীকে এ কথা জানাতেই তিনি বলেন, ‘তাহলে আমাকে তোমার ফুপু ভাবতে পারো।’
সেই থেকে আবির শাহানা চৌধুরীকে ফুপু ডাকে। আবিরের বাড়ি হচ্ছে পদিপাড়ায়, আর শাহানা চৌধুরীর কালিকাপুরে। দুই এলাকার দূরত্ব প্রায় ছয় কিলোমিটার। শাহানা চৌধুরী প্রায়ই আবিরকে তার বাড়িতে আসার আহ্বান জানান। কিন্তু পড়ালেখার চাপে আবির এতটাই ব্যস্ত থাকে যে তার কোথাও খুব একটা যাওয়া হয় না। কেবল অবসর পেলেই সে ফেসবুকে আসে।
২.
আজ সকালে শাহানা চৌধুরী ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে লিখেন, ‘হুমায়ূন আহমেদের ‘তিথির নীল তোয়ালে’ বইটা কারো কাছে থাকলে আমাকে পাঠান প্লিজ।’ আবির দুপুরে ফেসবুক ওপেন করতেই শাহানা চৌধুরীর এই স্ট্যাটাস দেখে। শাহানা চৌধুরী যে একজন বইপোকা মানুষ, এটা আবির ভালো করেই জানে। অন্য দিকে আবিরেরও বইয়ের দিকে দারুণ ঝোঁক আছে। এই প্রসঙ্গে দু’জনের ফেসবুকে প্রায়ই আলাপ হয়। হুমায়ূন আহমেদের তিথির নীল তোয়ালে বইটা আবিরের কাছে আছে। শাহানা চৌধুরীর স্ট্যাটাস দেখে আবির তাকে বইটি পাঠাতে আগ্রহী হয়। ইনবক্সে নক করে শাহানা চৌধুরীকে। কিন্তু শাহানা চৌধুরী তখন ইন্টারনেটে নেই। আবির সিদ্ধান্ত নেয় সে এখনই কালিকাপুর গিয়ে শাহানা চৌধুরীকে বইটা দিয়ে আসবে। এই উপলক্ষে ফেসবুকের অনেক দিনের চেনা মানুষটাকেও সরাসরি দেখা হবে।
লাল পাঞ্জাবিটা পরে নেয় আবির। বুক সেলফ থেকে বের করে তিথির নীল তোয়ালে। কালিকাপুর রওনা দেয়ার আগে শাহানা চৌধুরীকে মেসেজ লিখে, ‘বইটি নিয়ে আমি আপনার বাড়ি আসছি।’ বই হাতে নিয়ে একটি ছবি তোলেও শাহানা চৌধুরীকে ইনবক্সে পাঠায়। তার পর রওনা দেয় কালিকাপুরে।
৩.
শেষ বিকেলে ফেসবুক ওপেন করতেই আবিরের মেসেজ পান শাহানা চৌধুরী। সাথে ছবিটাও। ছবিতে লাল পাঞ্জাবি পরা তিথির নীল তোয়ালে বইটি হাতে ধরা আবিরকে দারুণ লাগছে। ছেলেটি আজ আসছে জেনে শাহানা চৌধুরীর ভালো লাগল। কিন্তু ও কালিকাপুর এসে ঠিকঠাক বাড়ি চিনবে তো!
শাহানা চৌধুরীর ভাই তানভীর বাসায় এসে জানায়, ‘আপা, এলাকায় একটা ছেলেধরাকে গ্রামবাসী গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলেছে। ছেলেটি ইয়ং। বটতলার মোড়ে লাশ পড়ে আছে।’ শোনে শাহানা চৌধুরী বলেন, ‘ঠিকই আছে। এদেরকে মেরে ফেলাই উচিত।’
ফেসবুক ঘাটতে ঘাটতে শাহানা চৌধুরী দেখেন পাড়ার অনেকেই ছেলেধরাটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা ফেসবুকে শেয়ার করছে। পিটুনিতে ছেলেধরার থেঁতলে যাওয়া লাশের ছবিও পোস্ট করা হচ্ছে। হঠাৎ ছেলেধরার লাশের একটি ছবি দেখে বুক ধক্ করে উঠল শাহানা চৌধুরীর। লাল পাঞ্জাবি পরা লাশটার চেহারার সাথে আবিরের চেহারার মিল আছে বেশ। আবিরও তো হুবহু এরকম একটি পাঞ্জাবি পরে এখানে আসার আগে ছবি তোলে তাকে ইনবক্সে পাঠিয়েছে। শাহানা চৌধুরী তানভীরের কাছে গিয়ে বলেন, ‘আচ্ছা ওই ছেলেধরার বয়স কত হবে?’ তানভীর জানায়, ‘আনুমানিক বিশ কি একুশ। পিটুনি খেয়ে বার বার বলেছেÑআমি ছেলেধরা নই।’ শাহানা চৌধুরী ঝড়ের বেগে আবার প্রশ্ন করেন, ‘ছেলেটার কাছে কিছু ছিল?’ তানভীর বলল, ‘হুমায়ুন আহমেদের কী একটা বই দেখেছিলাম মনে হয়।’ তানভীরের কথা শুনে অনবরত ঘামতে থাকেন শাহানা চৌধুরী। তারমানে আবিরকে ছেলেধরা সন্দেহে মেরে...! তানভীরকে আবার প্রশ্ন করেন শাহানা চৌধুরীÑ ‘লাশটা কি এখনো বটতলার মোড়ে আছে?’ তানভীর বলল, ‘আছে’।
শাহানা চৌধুরী পাগলের মতো দৌড়াতে থাকেন বটতলার মোড়ে। কী সর্বনাশ হয়ে গেল! আবিরকে মেরে ফেলা হয়েছে ভুল সন্দেহে। ছেলেধরা সন্দেহে। বটতলার মোড়ে অনেক মানুষ। লাশ কোথায়! শাহানা চৌধুরী লাশ খুঁজতে থাকেন। চাচাতো ভাই রনিকে দেখে শাহানা চৌধুরী জানতে চান, ‘লাশটা কোথায় ভাই?’ রনি বলল, ‘ওই তো। ওখানেই ছিল! পুলিশ এসে একটু আগে নিয়ে গেছে।’ শাহানা চৌধুরী চিৎকার দেন। তিনি স্পষ্ট দেখতে পান মাটিতে লাল লাল রক্তের ছোপ আর তার পাশে একটি বই পড়ে আছে। বইয়ের নামÑ তিথির নীল তোয়ালে। বইটির মলাটেও লেগে আছে রক্ত। আবিরের রক্ত; যাকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। শাহানা চৌধুরী ক্রমেই মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছেন।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী


আরো সংবাদ



premium cement