২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কুহক

চারাগল্প
-

হাসপাতালের বেডে শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি আজ আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। শ্রাবণ চলছে। মেঘ নেই। গত কয়েক দিন থেকে টানা বৃষ্টি ছিল। এই হাসপাতালে দশ দিন আগে আমার হার্টের অপারেশন হয়েছে। এখন খানিক সুস্থবোধ করছি। নাজমা নিরন্তর আমার সেবায় নিজেকে এ দশ দিন বিলিয়ে দিয়েছে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে আমাকে সুস্থ রাখার কী এক আপ্রাণ চেষ্টা দেখে স্বামী হিসেবে নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে হলো।
গত দশ দিন ধরে হাসপাতালে অনেকেই আমাকে দেখতে এসেছে। আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা, ছাত্রজীবনের বন্ধুরা, দূর সম্পর্কের আত্মীয়, এমন কী আমার ছেলে রনির বন্ধুরাও নিয়মিত এখানে এসে আমার খোঁজ-খবর নিচ্ছে। আল্লাহর কাছে সবার প্রার্থনা দেখে আনন্দে চোখে পানি চলে আসে। কিন্তু এদের সবার ভিড়ে আমি একজনকে খুঁজি। তার অপেক্ষায়ও থাকি। সে হলো সুইটি। আমার আদরের ছোটবোন। রোজ সকালে ভাবি সুইটি আজ নিশ্চয়ই ওর স্বামী জাবেদকে নিয়ে আমাকে দেখতে এখানে আসবে।
কিন্তু আসে না। হয়তো জানেও না তার ভাই জটিল অপারেশনের পর মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। সুইটির যখন নয় বছর বয়স, ওই সময়ে আমাদের বাবা-মা মারা যান। ছোট্ট সুইটিকে ওই বয়সেই আমি পিতৃস্নেহে বড় করেছি। অভাব-অনটনে প্রতিটি দিন শুরু হলেও ওকে কখনো অভাবের কষ্ট বুঝতে দেইনি। যখন যা চেয়েছে, দু হাতে ঢেলে দিয়েছি। আর্থিক সঙ্কট থাকার পরও সুইটিকে ডিগ্রি পাস করিয়েছি। এক সময়ে নাজমার সাথে আমার বিয়ে হয়। নাজমা ননদ হিসেবে সুইটিকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করলেও কেন জানি সুইটির নাজমাকে সহ্য হতো না। প্রায়ই ওদের ননদ-ভাবীর ঝগড়া হতো। কিন্তু কোথা থেকে এসবের সূত্রপাত, আমি বুঝতাম না। হয়তো নাজমা সুইটির মতো অত শিক্ষিত নয় বলে। শিক্ষিত মেয়ে হিসেবে সুইটির একটা অহঙ্কার ছিল। অথচ ওকে শিক্ষিত করার জন্য কী পরিমাণ শ্রম দিয়েছি আমি, সে কথা নাজমা ভালো করেই জানত। সুইটির প্রাইভেট পড়ার বেতন কিংবা পরীক্ষার ফরম ফিলাপের টাকার জন্য আমার বন্ধু হাবীবের কাছে প্রায়ই হাত পাততে হতো। হাবীব বলত, ‘আর পড়াসনে। এবার ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দে।’
ভালো ছেলের হাতেই তুলে দিয়েছি সুইটিকে। জাবেদ সম্ভ্রান্ত ঘরের শিক্ষিত ছেলে। চাকরি ভালো। দেখতেও ভালো, যদিও পেটটা একটু বড়। বিয়ের পর আমাদের সাথে যতটুকু যোগাযোগ রাখার কথা ছিল সুইটির, ততটুকু সে রাখে না। কখনো ফোনে জানতেও চায় না আমরা কি সুখে আছি, না আছি। ততদিনে আমার ছেলে রনি বড় হয়েছে। একদিন রনি ওর একমাত্র ফুপুকে ফেসবুকে পেয়ে যায়। তারপর থেকে সুইটির খবরাখবর আমরা ফেসবুকে পেতাম। সুইটি কখন কী ছবি ফেসবুকে ছেড়েছে, রনি সব দেখাত আমায়। সাজসজ্জায় অপরূপ বোনকে ফেসবুকে দেখে কেঁদে ফেলতাম। রনি হাসতো।
২.
দুপুর বেলায় এক অপূর্ব রূপবতী হাসপাতালে এসেছে। নাজমা ব্যাকুল হয়ে বলল, ‘এই দেখো, কে এসেছে! সুইটি। আমাদের সুইটি এসেছে।’ আমি সুইটিকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। অনেক দিন পর ওকে দেখলাম। সুইটি আমার পাশে বসে বলল, ‘ভাইজান, দেরি করে আসাতে স্যরি। ফেসবুকে রনির কাছে আপনার খবর নিতাম। ও তো বেশ স্মার্ট হয়েছে।’ নাজমা হেসে ফেলল। রনির কেউ প্রশংসা করলে নাজমা খুশি হয় খুব। মায়ের মন তো। নাজমার একটু আগে মাথাব্যথা উঠেছে। ওর মাইগ্রেনের প্রবলেম।
আমি সুইটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। এই সাজসজ্জায় কি দারুণ লাগছে আমার বোনকে। দামি পারফিউমের গন্ধে পুরো হাসপাতাল ভেসে যাচ্ছে।
সুইটি আসার কিছুক্ষণ পর দুনিয়া কাঁপা বৃষ্টি শুরু হলো। আমি, নাজমা আর সুইটি জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছি। একজন নার্স এসে জানায় আমাকে হার্টের ওষুধ এখন থেকে একসাথে দুটো করে খেতে হবে। নাজমা আমায় হার্টের ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে দেখে ওষুধ শেষ হয়ে গেছে। এখনই আনতে হবে। এই ঝড় বাদল মাথায় করে নাজমা যখন ছাতা নিয়ে বাইরের কোনো ফার্মেসি থেকে ওষুধ আনতে রেডি হলো, আমি বাধা দিয়ে বললাম, ‘আহা, তুমি বসো তো। তোমার মাইগ্রেনের পেইন। রেস্ট নাও। ছাতা সুইটিকে দাও। ও আনবে ওষুধ। ও অনেক দিন পর এসেছে। একটু ভাইয়ের সেবা করুক।’ সুইটি আপত্তির সুরে বলল, ‘আমি পারব না ভাইজান। বাইরে বৃষ্টি খুব। আমি পার্লার থেকে সেজে এসেছি। বৃষ্টির পানি মুখে পড়লে মেকআপ নষ্ট হবে। ভাবীই যাক না।’ নাজমা ছাতা নিয়ে কেবিন থেকে বের হতে হতে বলল, ‘ভাইকে হাসপাতালে দেখতে এসেছ পার্লার থেকে সেজে! হা হা হা। তুমি অন্তত এসেছ, এতেই আমরা খুশি।’
নাজমা ওষুধ আনতে চলে যাওয়ার পর ভেবেছি সুইটি আমার সাথে খোশ গল্পে বসবে। আমাদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলোচনায় মাতবে। অথচ সে একমনে বারান্দার পাশে নিরিবিলি চেয়ারে বসে ফেসবুকে ডুবে আছে। মোবাইল থেকে চোখ সরছে না। শুধু একবার জিজ্ঞেস করল, ‘রনি কোথায়?’ বললাম, ‘ওর অনার্সের পরীক্ষা চলছে। সন্ধ্যায় এখানে আসবে।’
মোবাইল বেজে উঠল সুইটির। কথা বলা শেষে বলল, ‘ভাইজান, জাবেদ ফোন করেছে। ফাইভ স্টার হোটেলে ও আমার অপেক্ষায়। আজ আমরা ওখানে লাঞ্চ করব। আসি তবে।’ বাধা দিয়ে বললাম, ‘এখনই যাবি? বৃষ্টিতো বেড়ে গেল। তোর মুখের মেকআপ নষ্ট হবে।’ ম্লান হেসে সুইটি বলল, ‘তবুও যেতে হবে ভাইজান। ও না হয় রাগ করবে। গেলাম।’ সুইটি সত্যি সত্যি চলে গেল।
৩.
সন্ধ্যায় রনি এসে শুনেছে সুইটি আজ এখানে এসেছে। আফসোসের সুরে বলল, ‘চলে যেতে দিলে কেন বাবা! আমি ফুপিকে ফেসবুক ছাড়া বাস্তবে দেখিনি।’ আমি রনির দিকে তাকিয়ে থাকি। ওর আজকাল ফেসবুকের নেশা বেড়েছে।
রনি বলল, ‘বাবা দেখো, ফুপি দুই মিনিট আগে এই ছবিগুলো ফেসবুকে পোস্ট করেছে। ক্যাপশনে লিখেছেÑ আজ আমরা বৃষ্টি বিলাস করলাম।’
ফেসবুকে সুইটির বৃষ্টিভেজা ছবিগুলো দেখলাম। এই সাজেই তো আজ ও এখানে এসেছে। জাবেদের সাথে অনেকগুলো ছবি দেখতে পাচ্ছি সুইটির। বৃষ্টির পানি ওদের দুজনের সারা গায়ে মুখে। সুইটির মেকআপ নষ্ট হলো না তো! জাবেদকে ছবিতে সুন্দর লাগছে। পেট কমেছে অনেকটা। ছবিগুলো মনে হচ্ছে কোনো ছাদে তোলা। ফাইভ স্টার হোটেলের ছাদ না তো! নাকি সুইটির দামি ফ্ল্যাট বাড়ির ছাদ। ওরা যখন ছাদে ছবিগুলি তুলেছিল, তখন কী মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিলো!
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।

 


আরো সংবাদ



premium cement