২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রূপের রানী দার্জিলিং

ভ্রমণ
-

মনকাড়া কিংবা মনভোলানো যাই বলি না কেন, দার্জিলিংয়ের অপরূপ সৌন্দর্য অক্ষরের তুলিতে ফুটিয়ে তোলার সাধ্য আমার নেই। শিলিগুড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে ১০ রুপি অটো ভাড়া দিয়ে দার্জিলিং মোড় আসি। এখানে এসে দাঁড়ালেই আমাদের দেশের সিএনজি ড্রাইভারদের মতো জিপড্রাইভাররা চারদিক থেকে ঘিরে ধরে। কোথায় যাবেন! দার্জিলিং! দার্জিলিং! বলে চারপাশ থেকে ডাকতে থাকে। এক নেপালি ড্রাইভারের সাথে দরদাম ঠিক করে উঠে পড়ি তার গাড়িতে। নেপালিরা যে জাতি হিসেবে কতটা রসিক এবং ফুরফুরে মেজাজের হয় পুরো যাত্রাপথে তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।
আগেই জেনেছি, শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং তিন-চার ঘণ্টার পথ। পুরোটা সময় যেন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে যেতে পারি তাই জানালার পাশেই বসেছি। আমার পেছনে বসেছে সফরসঙ্গী আমার ভাই রবিউল। আর পুরো জিপে তিনজন মেয়ে দুইজন ছেলে। তাদের বাড়ি দার্জিলিংয়েই। এই প্রথম ‘দার্জিলিং’ ঘুরতে যাচ্ছে ওরা!
জেনে রাখা ভালো, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি বিভাগ জলপাইগুড়ি। জলপাইগুড়ির একটি জেলা দার্জিলিং। দার্জিলিং নামে আলাদা একটি পৌরসভা রয়েছে দার্জিলিংয়ের ভেতরেই। সমতল ভূমি থেকে সাত হাজার ১০০ ফুট উপরের শহরটিই আসল দার্জিলিং। দার্জিলিংয়ের অন্যান্য শহর হলো শিলিগুড়ি, কার্শিয়ং ও কালিম্পং। আমরা এবং ওরা মানে পাঁচ তরুণ-তরুণী দার্জিলিংয়ের যাত্রী। পাহাড়ের মেহমান।
একজন ছিল কার্শিয়ংয়ের যাত্রী। অজিতকুমার দাস। তিনি বাংলাদেশ থেকে আমাদের সাথেই এসেছেন। টুকটাক কথাবার্তাও হয়েছে। গাড়ি ছেড়ে দেয়ার পর থেকেই অজিত বাবু নানান গল্প ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে শুরু করেন। অজিত বাবু সাথে থাকায় লাভ হয়েছে এতটুকু, দার্জিলিং পৌঁছার আগেই দার্জিলিংয়ের গল্প-অভিজ্ঞতা শোনা হয়ে গেছে ঢের।
সেদিন ছিল ২ এপ্রিলের। প্রচণ্ড গরম। গাড়ি ছুটছে দার্জিলিংয়ের উদ্দেশে। শুরুতেই আরেকটি ধাক্কা খেলাম। ভুল বললাম। শিক্ষা পেলাম। দার্জিলিংয়ের দুটো অংশ। সমতলভূমি। এখন যেখানটায় আমরা গাড়ি ছুটিয়ে চলছি। উচ্চভূমি। যেখানটায় আমাদের গন্তব্য। সমতলভূমির পুরোটা ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প, কোয়াটার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। বিশাল এলাকাজুড়ে তাদের অবস্থান। মাঝে মধ্যে বিশাল চা বাগান। কখনো ঘন বন। অজিত বাবু বলছিলেন, ভাগ্য ভালো থাকলে পথে হাতির দেখাও পেয়ে যেতে পারো তোমরা। রাস্তায় বড় বড় ব্যানের ইংরেজিতে লেখা, ‘বন্যপ্রাণীদের নিরাপদে যেতে দিন’। ভাগ্য আমাদের প্রসন্ন হয়নি। যাওয়ার সময়ও না। আসার সময়ও না। তাই হাতির আর দেখা পাইনি। তবে আসার সময় একটি বনমোরগ লাফিয়ে আমাদের গাড়িতে আছড়ে পড়ে। প্রথমটায় ভয় পেয়ে যাই। পরে অবশ্য খুব হাসাহাসি হয়েছে এ নিয়ে।
এবার শিক্ষার কথাটা বলি। সেনাবাহিনীর গাড়ি আসছে সামনে থেকে। আমাদের গাড়ি একটু আগে বাড়িয়ে গেছে। রাস্তাও বেশ প্রশস্ত ছিল না। এ ক্ষেত্রে নিয়ম হলো, যেকোনো একদিকের গাড়ি থেমে অন্য গাড়িকে যাওয়ার জন্য সুযোগ করে দেবে। পুরো দার্জিলিংয়ের এই বিষয়টিই সীমাহীন মুগ্ধ করেছে আমাকে। যেহেতু আমিও দেশে একটি গাড়ি চালাই। আমাদের দেশের রাস্তার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ জানা আছে আমার। একটু ফাঁক পেলেই কিভাবে সেখানে গাড়ির মাথা, সাইকেলের মাথা ঢুকিয়ে জ্যাম বসে থাকা যায় এ সুকর্মে (!) বেশ পারদর্শী আমরা।
গাড়ি ঢুকে গেছে ঘন বনের রাস্তায়। দুই পাশে গভীর বন। মাঝখানে রাস্তা। এত মনোমুগ্ধকর বলে বোঝাতে পারব না। অজিত বাবু বললেন, দেখো কত বনজ সম্পদ গাছগাছালি পড়ে রয়েছে। চোখ মেলেও তাকায়নি কেউ। আমাদের দেশে হলে এত বিশাল বিশাল সেগুন গাছ কি আস্ত থাকত! এই যে দার্জিলিং যাচ্ছ, দেখবে কিভাবে পাহাড় কেটে রাস্তা-ঘরবাড়ি বানিয়েছে মানুষ, কিন্তু পাহাড়ের সৌন্দর্যকে নষ্ট হতে দেয়নি একটুও। আমাদের দেশে হলে এ পাহাড় কি পাহাড়ের জায়গায় থাকত? আমরা রাখতাম? ওই দেখো দেখো পাহাড় দেখা যাচ্ছে, বলেই হাত উঁচু করে দেখালেন অজিত বাবু। সমতলভূমি থেকে পাহাড় দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের বিশালতা কখনোই অক্ষরের তুলিতে ফুটিয়ে তোলা যায় না। সম্ভবও নয়। দুই চোখ যেদিকে যায়, শুধু পাহাড় আর পাহাড়। মেঘের সাথে মিশে আছে পাহাড়। আকাশের সমান উচ্চতা নিয়েও কি মৌন নীরব গম্ভীর হয়ে আছে সে। সম্ভত এ জন্যই অহঙ্কারী মানুষকে উদ্দেশ করে পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক বলেছেন, ‘চালচলনে দাম্ভিক হয়ো না। তুমি তো পাহাড়ের মতো উঁচু হতে পারবে না।’ অর্থাৎ পাহাড় এত বড় হয়ে কত নীরব, কত নিরহঙ্কার। তাহলে হে মানুষ! তুমি কেন অহঙ্কার করছ। তুমি তো পাহাড়ের মতো উঁচু হতে পারোনি। পারবেও না। সুতরাং অহঙ্কার করো না।
দার্জিলিং ছবির মতো সুন্দর একটি শহর। মনভোলানো শহর। টাইগার হিলের সূর্যোদয়, জুলজিকাল পার্ক, ঘুম বৌদ্ধ মনেস্ট্রিসহ আরো অনেক দর্শনীয় স্থান আছে। কিন্তু ওপরে উঠতে উঠতে পাহাড়ের হাতছানি, ওই তো পাহাড় দেখা যাচ্ছে, একটু পরেই পাহাড়ে উঠে যাবো এই অপেক্ষায় থাকা আর পাহাড়কে অনুভব করার সৌন্দর্যই সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। মুখ ফুটে তখন শুধু একটি কথাই বেরিয়ে পড়ে, সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ পাকের সৃষ্টি যদি এত সুন্দর হয়, তাহলে আল্লাহ পাক না জানি কত সুন্দর!
দার্জিলিং পৌঁছে কয়েকজন বাঙালির সাথে পরিচয় হয়েছে। আমাদের পাশের এলাকা জুরাইন থেকে গেছেন মিজান ও শাহাদাত ভাই। জুলজিকাল পার্ক, রক গার্ডেন, অপূর্ব সুন্দর চা বাগান দেখার পর শাহাদাত ভাই বললেন, মামুন ভাই! এসবই সুন্দর! কিন্তু পাহাড়ি পথে যে আসলাম ওটাই বোধহয় দার্জিলিংয়ের আসল সৌন্দর্য। আঁকাবাঁকা পথে গাড়ি উঠছে। আর পাহাড় একটু একটু করে আমার কাছে দৃশ্যমান হচ্ছে। আবার পাহাড়ের গা ঘেঁষে মানুষের বসতি। স্কুল-কলেজ বাজার কি যে অপূর্ব! অসাধারণ! এসব চোখে না দেখলে কখনো বলে বা ফটো দেখে এমনকি ভিডিও দেখেও সৌন্দর্য উপলব্ধি সম্ভব নয়।
পুরো ভ্রমণপথ মাতিয়ে রেখেছে নেপালি ড্রাইভার। সাধারণ কথা বলছে, তাতেও যেন রস উপচে পড়ছে। যখন পাহাড়ের কাছা কাছি চলে গেলাম, একটি রেস্টুরেন্টের সামনে এসে থামল। নেপালি ভাষায় বলল, ‘খানাপিনা করে নাও।’ দার্জিলিংয়ের মানুষ বেশির ভাগই নেপালি ভাষায় কথা বলে। বাংলাও বোঝে।
রেস্টুরেন্টে নেমে জানতে চাইলাম হালকা খাবার কী আছে। দুপুরের খাবার দার্জিলিং গিয়ে খাবো, তাই হালকা কিছু খেয়ে নেয়া। ভেজিটেবল মমো দিতে বললাম। দেখেই মন উঠে গেল। ভেতরে সবজি দিয়ে ওপরে পিঠার মতো। তবে পুরোটাই সেদ্ধ। খুব অনিচ্ছা নিয়ে মুখে দিলাম। মনে হলো অমৃত মুখে দিয়েছি। বেশ সুস্বাদু। খেলামও মজা করে।
গাড়ি ছুটছে। আরো ঘণ্টা দুই চলার পর কার্শিয়ং স্টেশনে এসে থামল। অজিত বাবু নেমে গেলেন। এবার একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। তবুও খারাপ লাগছে না। আগের দিন বিকেলে ৪টায় ঘর থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠেছি, এখন আবার ৪টা বাজল, টানা ২৪ ঘণ্টার জার্নি হয়ে গেল, খুব একটা খারাপ লাগছে না।
যতই ওপরে উঠছি, ততই আবহাওয় ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। একটু পর পর মনে হচ্ছে দার্জিলিং বুঝি এসেই পড়েছে, পাশেরজনকে জিজ্ঞেস করলাম আর কতক্ষণ? তিনি বললেন, আরো দেড় ঘণ্টা। আর কতক্ষণ? আরো এক ঘণ্টা। আধা ঘণ্টা। আসলে নতুন যারা দার্জিলিং আসে, তাদের অবস্থা এমনই হয়, কিছু দূর যাওয়ার পর মনে হয় এটাই বুঝি দার্জিলিং। এভাবে চার ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে আমরা সত্যি সত্যিই দার্জিলিং এসে পৌঁছলাম। দার্জিলিং আমাদের বৃষ্টি ঝরিয়ে রোদ ঢেলে অভিবাদন জানাল।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement