২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গাছে গাছে লটকন

-

বছর ঘুরে আবারো গাছে গাছে ঝুলছে সুস্বাদু টক-মিষ্টি মওসুমি ফল লটকন। সেই লটকনের স্বাদ আর সৌন্দর্য দেখতে দে-ছুট ভ্রমণ সঙ্ঘের প্রিয় শুভাকাক্সক্ষী চরউজিলাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি হুমায়ুন কবির ভাইয়ের আমন্ত্রণে গত শুক্রবার বন্ধুরা ছুটি ঢাকার পাশেই নরসিংদী। গিলাবের গ্রামের বাসিন্দা, ভাঙ্গারটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাসুদ রানা মনির ভাই আগেই কোন কোন বাগানে ঘুরব তা ঠিক করে রেখেছিলেন। কারণ সব বাগানের ফলন এক রকম নয়। আদি ঢাকা থেকে শিবপুর উপজেলার গিলাবের গ্রামে পৌঁছতে সময় লাগল প্রায় ৩ ঘণ্টা। অবশ্য মাঝে ভেলানগর গরুর দুধের সুস্বাদু মালাই চার জন্য ছিল বিরতি। ওদিকে বেচারা মনির ভাই, সকাল থেকে অপেক্ষায় থাকতে থাকতে পুরাই অস্থির। আমাদের পেয়ে তিনি এবার বেজায় খুশি। কুশল বিনিময় শেষে যেতে চাইলাম বাগানে। কিন্তু কার কথা কে শোনে! একরকম জোর করেই নিয়ে চললেন তার বাড়ি। মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলাম। কারণ ঘুরবাজ মানুষ আমরা- কারো বাসায় বেড়াতেতো আর আসিনি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে হলো। বাড়িতে ঢুকতেই চোখ সবার কপালে। আরে এটা তো বসতবাড়ি নয় যেন বাগানবাড়ি। বাড়ির আঙিনায় হরেক পদের ফল ও ফুলগাছ। কাঁচাপাকা লটকন আর বিশাল বিশাল সাইজের কাঁঠাল ঝুলছে গাছে গাছে।
যাই এবার জুমা আদায়ে। নামাজ শেষে জম্পেশ খানাদানা। বেলা প্রায় ৩টা। আর দেরি নয়, বের হয়ে গেলাম বাগান দেখতে। বাড়ি থেকে বাগান প্রায় দুই কিলোমিটার। গাড়ি চলছে, অবারিত সবুজের মাঝে পিচ করা সরু পথে। চারপাশ সবুজ আর সবুজ। প্রকৃতি যেন তার সবটুকুন উজাড় করে দিয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছাই নির্ধারিত বাগানে। সেখানেও অপেক্ষায় ছিলেন তরুণ শিক্ষক ও লটকন বাগান মালিক ছালাম ভাই। বাগানে ঢুকতেই চোখে ধরা দেয় এক অন্যরকম প্রকৃতি। যতই এগিয়ে যাই ততই যেন মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হই। ধীরে ধীরে ডুবে যাই আমরা, শত শত গাছে ঝুলে থাকা লটকনের স্তূূপে। যতদূর চোখ যায়, শুধু লটকন আর লটকন। অনুমতি থাকায় আমরা যে যার ইচ্ছামতো, গাছ থেকে পেড়ে খাই। সে এক অন্যরকম অনুভূতি।
পুরো জেলাই বিভিন্ন ফল আর সবজির জন্য বেশ বিখ্যাত। তবে লটকন নরসিংদীর দুটো উপজেলাÑ বেলাব ও শিবপুরে বেশি ফলন হয়ে থাকে। তার মধ্যে গিলাবের, বটেশ্বর, লাখপুর, আজলিতলা, ওয়ারি ও মরজাল গ্রাম প্রসিদ্ধ। এই গ্রামের প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনায় রয়েছে লটকন গাছ। সেই সাথে পরিকল্পিত বাগান। কোনো কোনো গাছে ৩১৫ কেজি পর্যন্ত লটকন ধরে। এসব গ্রামের বেশির ভাগ পরিবারই লটকন ফল বিক্রির ওপর নির্ভরশীল। চারা রোপণের তিন বছরের মাথায় ফলন আসতে শুরু করে। প্রায় ষাট বছর বয়স পর্যন্ত গাছটিতে ফল ধরে থাকে। লটকন ফলের জন্য দেশের ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও নরসিংদী জেলা বেশ বিখ্যাত। তবে নরসিংদীর লটকন আকার ও স্বাদে অন্য দুই জেলা থেকে অধিক বড় এবং সুস্বাদু। দেশের মোট উৎপাদনের ৮০ ভাগই হয় নরসিংদীতে। মরজাল হলো লটকনের বৃহৎ পাইকারি বাজার। লটকন কেনার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে পাইকাররা আসে। বর্তমানে লটকন দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশেও রফতানি করা হয়। লটকন ফল জুন থেকে আগস্টÑ এই তিন মাস গাছে ধরে। লটকন ফলে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন সি। অন্যান্য ফলের চেয়ে লটকনে আয়রনের পরিমাণও বেশি। এই ফলের গাছের পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে খেলে ডায়রিয়া উপশমে বেশ কার্যকর। লটকন গাছ খুব একটা পরিচর্যা করারও প্রয়োজন পড়ে না। রোগবালাইও তেমন নেই। ফলে দিন দিন স্থানীয়রা লটকন বাগানের দিকে ঝুঁকছে।
গোলাকৃতির এই ফল মাত্র এক দশক আগেও অনেক জেলার মানুষের কাছে জঙ্গলি ফল হিসেবে পরিচিত ছিল। থোকায় থোকায় এই ফল একেবারে গাছের গোড়ার প্রায় মাটি স্পর্শ থেকে মগডাল পর্যন্ত ধরে থাকে। পাকা ফল হলদে ও অনেকটা জাফরান আর কাঁচা অবস্থায় প্রায় সবুজ রঙা থাকে। লটকন ফল বিভিন্ন জেলায় ভিন্ন ভিন্ন নামে ডেকে থাকে। যেমন লটকা, ডুবি, বুবিসহ আরো হরেক নামে। নেত্রকোনা জেলার স্থানীয় মানুষ একসময় লটকন ফলকে পাগলা গোটা হিসেবে আখ্যায়িত করত। এখন সেই পাগলা গোটা ডুবি বিক্রি করে অনেকেই সংসার চালায়। সময়ের আবর্তনে লটকন এখন দেশের অর্থকরি ফসল। দিন শেষে আমরাও বিভিন্ন গাছের লটকন চেখে, পছন্দমতো গাছের উৎকৃষ্টমানের সুস্বাদু লটকন নিয়ে ফেরার পথ ধরি।


আরো সংবাদ



premium cement