২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ছাতা ধর হে

জীবনের বাঁকে বাঁকে
-


‘মন থেকেই আপনার জন্য দোয়া করি, আপনি ভালো থাকুন। আপনার ভেতরে যে একটা সুন্দর মন আছে তা আজ আমি দেখলাম। আল্লাহ আপনার ভালো করুক।’
তার নাম আমি জানি না, জানার কথাও না। ঢাকা শহরে হাজার হাজার রিকশাওয়ালা। প্রতিদিন একবার হলেও রিকশায় না ওঠার মতো লোক খুব কম এই শহরে। দুপুর ১২টায় বের হই সাবরেজিস্টার অফিসে যাওয়ার জন্য। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাজে গত দু’দিন অনেকক্ষণ সময় করে বাইরে ছিলাম। মোবাইল ম্যানিব্যাগের সাথে সঙ্গী হলো দুই বোতল পানি আর একটা ছাতা। আজও সাথে তাই। যেভাবে রোদ পড়ছে, ছোটবেলায় শুনেছি এমন রোদ পড়লে বলত ঠাটাভাঙ্গা রোদ। আধাপাকা চুলের রিকশাওয়ালার বয়স ৫০ কি ৫৫ হবে। রিকশা ভাড়া ৬০ টাকা চেয়েছে, কিছুই না বলে উঠে পড়েছি।
হুট উঠানো রিকশায় বসা আমি। সূর্যের তেজ আমার শরীরে পড়ে না। তবে দুই পায়ে পড়ছে, মনে হচ্ছে পা পুড়ে যাচ্ছে। সিটে বসতেই রিকশা চলতে শুরু করে। ছাতার প্রয়োজন নেই আমার, তবুও ছাতাটা খুলে হাতটা লম্বা করে ছাতা ধরে রাখলাম পঞ্চাশ বছর বয়সী চাচার মাথায়। বিষয়টা তিনি খেয়াল করলেন। আশপাশের লোকেরাও। কেউ কেউ তাকিয়ে দেখছে। রাস্তায় কোথাও জ্যাম ছিল না, চালানো দেখেই বুঝেছি চাচা মিয়া ভালোই পারদর্শী রিকশা চালাতে। মুহূর্তে মরহুম মেয়র আনিসুল হক সড়ক হয়ে সাতরাস্তা দিয়ে সাবরেজিস্টার অফিসে। মাত্র মিনিট দশের মাঝেই সাবরেজিস্টার অফিসের কাজ শেষ আমার। বেরিয়ে এসে এপাশ ওপাশ তাকাই, যদি চাচা মিয়াকে পাই, তার রিকশায় চলে যাবো।
না, চাচা মিয়াকে পাইনি। সামনে যে রিকশা পেলাম তাতেই উঠে গেলাম। ভাড়া যা বলেছে, মেনে নিয়েছি। রিকশায় উঠেই ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে পানি খাচ্ছি। তাই দেখে ৪০-৪৫ বছর বয়সী চাচা রিকশা আর টান দিলেন না। ঢগঢগ করে পানি খাওয়ার ফাঁকে ভাবি, নিশ্চয়ই তিনি ভাবলেন পানি যখন খাচ্ছে, খেয়ে নিক। খাওয়া শেষ হলেই চাচা বলেনÑ
যাবো।
জি।
রিকশা চলতে শুরু করল। গরম দেখে সেদিন আহসান বলল,
আল্লাহ্ আমাদের শাস্তি দিচ্ছেন।
সত্যিই শাস্তি বটে। তখনকার মতো রোদ পুরাই পায়ে পড়ছে। রিকশায় বসলে আমি সব সময় চালকের সিটের সাথে হাঁটু আটকে রাখি, না হয় পড়ে যাওয়ার ভয়ে থাকি। যাওয়ার মতো ছাতাটা খুলে চাচা মিয়ার মাথায় ধরি। সাতরাস্তা হয়ে যেই রিকশা কাওরান বাজার রেলক্রসিংয়ের কাছাকাছি এলো দেখি সে কি জ্যাম! ট্রেন যাচ্ছে। মিনিট পাঁচ-সাত থাকার কথা। সেখানে পুরো ৩০ মিনিট। কারণ সিগনাল পড়ার পর সাতরাস্তা থেকে আসা অনেক রিকশা, গাড়ি বিপরীত রাস্তায় ঢুকে পড়ে। যার ফলে সিগনাল ওঠার পর বিপরীত পাশের গাড়ি তাদের নির্ধারিত রাস্তা দিয়ে আর যেতে পারছে না। ট্রাফিক এসে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে রিকশাওয়ালাদের। বাধ্য হয়ে সব পেছনের দিকে পাঠিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করে, তা করতে করতে আবার ট্রেনের সিগনাল পড়ে।
প্রথম এসেই যখন সিগনালে অপেক্ষা করি, এই ঠাটাভাঙ্গা রোদে রিকশাওয়ালাদের অবস্থা খুবই করুণ। রাস্তার পাশে যাদের রিকশা তারা রিকশা জ্যামে রেখে পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আর রাস্তার মাঝে যারা তাদের তো বসারও জায়গা নেই। আমি তো চাচার মাথায় ছাতা ধরে আছি। মনে পড়ে যায় সেই গানের কথা, ছাতা ধর হে ...। ছাতাটা চাচার হাতে দিয়ে বলিÑ
আপনি ধরেন, তাহলে দুই তিনজন অন্তত ছাতার নিচে দাঁড়াতে পারবে। সত্যি তাই করে। প্রায় ২০-২৫ মিনিট তিনজন রিকশাওয়ালা এই ছাতার নিচে দাঁড়ায়। ওদের শরীর থেকে টপটপ ঘাম ঝরছে। আমি বোতল থেকে কয়েক ঢোঁক পানি খেলাম। মনে পড়ে গত বছরের কথা, এমন সময়েই প্রতিদিন কয়েকজন রিকশাওয়ালাকে পানি আর খাবার স্যালাইন দিয়েছিলাম। ট্রেন চলে যায়, জ্যাম খুলে আসে। আস্তে আস্তে সব রিকশা চলতে শুরু করে। আমিও গন্তব্যে পৌঁছাই। ছাতা বন্ধ করে চাচা মিয়ার ভাড়া পরিশোধ করে নামার সময় তিনি কথাগুলো বলে ওঠেন। আমরা ভাবি হয়তো আঞ্চলিক ভাষায় ওরা কথা বলে, কিন্তু এত সুন্দর শুদ্ধ ভাষায় কথা শুনে আমি হা হয়ে যাই।


আরো সংবাদ



premium cement