১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাধাহীন দুরন্ত শৈশব

জীবনের বাঁকে বাঁকে
-


কিছু দিন আগে রাজশাহী শহরের একটা স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেখানে এমন একটি দৃশ্য আমার নজরে এলো, যে দৃশ্যটা আমাকে বেশখানিকটা পীড়া দিয়েছে। স্কুলে তখন ক্লাস শেষের ঘণ্টা বেজে উঠেছে। ঘণ্টা পড়ার সাথে সাথে স্কুলের মেইন গেট বন্ধ হয়ে গেল। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে একজন বাদাম বিক্রেতা এবং একজন ঝালমুড়ি বিক্রেতা। ছোট শিশুরা গেটের নিচ দিয়ে খাবার কিনে নিচ্ছে। যেহেতু শিশুর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি, তাই সবাইকে একসাথে খাবার দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। কয়েকটা শিশু টাকা হাতে গেটের বাইরে দাঁড়ানো বিক্রেতাদের দিকে অসহায় চোখ মেলে তাকিয়ে রয়েছে। এই দৃশ্যটা আমাকে যারপরনাই পীড়া দিয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, খাঁচায় বন্দী থাকা কোনো পাখি যেন খাবারের আশায় ছটফট করছে।
শিশুদের গেটের ভেতর আটকে রাখার যৌক্তিক কারণ অবশ্যই রয়েছে। এটা আমি বেশ ভালোমতোই জানি। বিশেষ করে শহরের স্কুলগুলোতে শিশুদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ এমনটি করতে বাধ্য হয়। অভিভাবকেরাও চান তাদের সন্তানেরা সর্বোচ্চ পরিমাণ সুরক্ষার মধ্যে স্কুল শেষ করে বাসায় ফিরে আসুক। ফলে আমাদের দেশের শহরের স্কুলগুলোতে শিশুদের খাঁচাবদ্ধ পাখির মতো জীবন অতিবাহিত করতে হয়। আমি শহরের অনেক স্কুলের কথা জানি, যেখানে খেলাধুলা এবং হেঁটে বেড়ানোর জন্য বেশ বড় মাঠের ব্যবস্থা আছে। বিশেষ করে সরকারি স্কুলগুলো নির্মাণের ক্ষেত্রে সবার আগে পর্যাপ্ত অবকাঠামোকে গুরুত্ব দেয়া হয়। খেলার মাঠে শিশুরা খেলাধুলা করার পাশাপাশি নিজেদের শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ পায়। কিন্তু শহরে যেসব বেসরকারি স্কুল রয়েছে সেখানে পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। দু-একটা বিল্ডিংয়েই শিশুদের পদচারণা সীমাবদ্ধ রাখা হয়। তারপর যদি তাদের স্কুলের পুরো সময়টা তালাবদ্ধ করে রাখা হয়, তাহলে অবস্থা কেমন দাঁড়ায় একটু অনুমান করে দেখুন। আমরা কি আমাদের শিশুদের ধীরে ধীরে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ করে গড়ে তুলছি না?
আমার মনে পড়ে যায় শৈশবের সেই সোনালি দিনগুলোর কথা। আমি আমার শিক্ষাজীবনে কলেজ পর্যন্ত গ্রামে থেকে পড়াশোনা করে এসেছি। ফলে শহরের তালাবদ্ধ স্কুলের সাথে আমার পরিচয় সামান্য। সেখানে শিশুদের মানসিক অবস্থা কেমন হয়, সেটাও বুঝে ওঠার সাধ্য আমার নেই। তবে আমার মনে হয়, শহরে বেড়ে ওঠা এবং পড়াশোনা করা এসব শিশু এমন অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত, যার স্বাদ আমরা পেয়ে এসেছি। আমার গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের পাশ দিয়ে বিশাল একটা খাল বয়ে গেছে। ছোটখাটো একটা নদীর মতো দেখতে সেই খালের পাড়ে আমার স্কুলের সীমানার মধ্যেই বিশাল আকারের একটা বটগাছ ছিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে, টিফিনের ঘণ্টা বেজে ওঠার সাথে সাথেই আমরা ছুটে যেতাম বটগাছের নিচে। গাছের কাণ্ড থেকে নেমে আসা ঝুল ধরে ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত ঝোলাঝুলি করে তারপর ক্ষান্ত হতাম। সে বটগাছটি কেটে ফেলা হয়েছে বহু আগেই। স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে এখনো বটগাছটার শূন্যতায় মন হু হু করে কেঁদে ওঠে।
স্কুল প্রাঙ্গণে ছোটখাটো হলেও একটা মাঠ ছিল। আমরা মাঠে ছুটে বেড়াতাম। এমন কোনো খেলা নেই, যা আমরা খেলিনি। আমি স্কুল শুরু হওয়ার অনেক আগেই চলে যেতাম। আমার অনেক বন্ধুও চলে আসত। সবাই মিলে খেলাধুলা করতাম যতক্ষণ না কোনো শিক্ষক এসে উপস্থিত হতেন। এমন দৃশ্য এখন আর তেমন একটা চোখে পড়ে না স্কুলগুলোতে গিয়ে। শিশুরা কেমন যেন হয়ে গেছে। আকাশ সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান বিকাশ আমাদের মানবিক সত্তাকে ধ্বংস করে দিতে উদ্যোগী হয়েছে পুরোপুরি। আজকে আমাদের শিশুরা সহজেই বিপথগামী হয়ে যাচ্ছে। সমাজের মূলধারার সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারছে না অনেকেই। মোবাইল গেমস আর টিভি কার্টুন আমাদের শিশুদের গ্রাস করে নিয়েছে পুরোপুরি। অবশ্য এতে যতটা না দায় আমাদের শিশুদের, তার চেয়ে বেশি দায় আমাদের অভিভাবকদের।
আমাদের সব সময় মনোযোগ থাকে কিভাবে শিশুকে ভালো রেজাল্ট করানো যায়। এ জন্য তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে পড়া গলাধঃকরণ করানো হয়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত স্কুলে কাটিয়ে দেয়ার পর একটা শিশুকে আবার পাঠানো হয় কোচিং সেন্টার কিংবা প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার আগে যে তার মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার প্রয়োজন, এটা কখনো ভেবে দেখি না আমরা। সারা দিন পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া একটা শিশু কিভাবে খেলাধুলা করতে যাবে? তা ছাড়া অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানকে ঘরে আটকে রাখেন। বাইরে গেলে নাকি সন্তান নষ্ট হয়ে যেতে পারে! এভাবে দিনের পর দিন একটা শিশুকে আবদ্ধ অবস্থায় রাখতে রাখতে তার ভেতরটা আমরা ধ্বংস করে ফেলি। তার আত্মাকে মেরে ফেলা হয় পুরোপুরি। ফলে মানবিক কোনো ব্যাপার আর তাকে স্পর্শ করতে পারে না এতটুকুও।
আমরা আমাদের শৈশব কাটিয়ে দিয়েছি দুরন্ত ও বাধাহীন অবস্থায়। আমরা স্কুলে গিয়ে ক্লাস করেছি। শিক্ষকদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে সেটা নিজেদের জীবন ও কর্মে বাস্তবায়ন করেছি। স্কুল ছুটি হলে এক দৌড়ে বাড়িতে চলে এসেছি। কোনো মতে খেয়েই গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছি পুকুর কিংবা খালের পানিতে। লাঠি হাতে মা এসে তাড়িয়ে নিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ডুবসাঁতার কেটেছি মনের আনন্দে। বিকেলে সোজা চলে গেছি খেলার মাঠে। আবার সন্ধ্যা হলেই বাড়িতে এসে বই নিয়ে বসেছি। আমাদের জীবনও একটা রুটিন মেনে চলত। তবে সে রুটিন ছিল আমাদের একান্তই নিজস্ব। সেখানে প্রবেশের অধিকার ছিল না কারো। এমন দুরন্ত শৈশব কাটিয়েই আমরা মানুষ হয়েছি। আমাদের মানবিক সত্তা নষ্ট হয়ে যায়নি এতটুকুও। শৈশবের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়লে আমার খুব আফসোস হয়। কিন্তু আমার সেই আফসোসকে ছাপিয়ে যায় যখন দেখতে পাই, আমরা যা পেয়েছি তার কিছুই আজকের শিশুরা পাচ্ছে না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement
তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ৭ দিন স্কুল বন্ধের দাবি চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত বিএনপি সাম্প্রদায়িক শক্তি, এদের রুখতে হবে : ওবায়দুল কাদের সাদিক এগ্রোর ব্রাহামা জাতের গরু দেখলেন প্রধানমন্ত্রী ভারতে লোকসভা নির্বাচনে প্রথম ধাপে ভোট পড়েছে ৬০ শতাংশ সারা বিশ্ব আজ জুলুমবাজদের নির্যাতনের শিকার : ডা. শফিকুর রহমান মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশী : পররাষ্ট্রমন্ত্রী চন্দনাইশ, বাঁশখালী ও বোয়ালখালীতে ৩ জনের মৃত্যু গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়াল শ্যালকের অপকর্মে দুঃখ প্রকাশ করলেন প্রতিমন্ত্রী পলক রাজশাহীতে ট্রাকচাপায় ৩ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

সকল