২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রঙহীন জীবন

জীবনের বাঁকে বাঁকে
-

শপিংয়ের তাড়া নেই এবার নিজেদের, যার জন্য যেটুকু না করলেই নয়, তাই করা হলো। হয়তো এটাও একটা রেকর্ড হতো যে, এবার শপিংয়ে আমার যাওয়ার দরকার পড়েনি। অবশ্য ২০১৬ সালের রমজানের ঈদেও শপিংয়ে যাইনি। রমজানের ঠিক ছয়-সাত দিন আগে পা ভেঙে একমাস প্লাস্টার করা পা নিয়ে বিছানায়। যাক কয়েক দিন থেকে মায়ের সাথে দেখা নেই, মা থাকেন সাভারে। দুই সপ্তাহ ধরে মা ডাকছেন। তাই ইফতারি, রাতের আর সাহরির খাবারের ব্যবস্থা করে দুপুরেই রওয়ানা মায়ের বাসায়। বের হবো, ঠিক তখনি মায়ের কলÑ
-- মনা, আমি আর নাজু তো শপিংয়ে যাচ্ছি, তুই কখন আসবি।
-- মা আমি বের হচ্ছি এখনই, কাছাকাছি গিয়ে কল দেবো। তোমরা শপিংয়ে থাকলে শপিংমলের সামনে নামব, আর বাসায় গেলে রেডিও কলোনি গিয়েই নামব।
-- আচ্ছা, ঠিকভাবে আসিস।
বাসে উঠেছি অনেক কষ্ট করে, উঠেও সিট নেই সেই গাবতলী পর্যন্ত। জানি আজ আমার সাথে অন্য কেউ থাকলে আর আশা হতো না। কারণ এত কষ্ট করে অন্য আসতে চাইত না। যা হয় ভালোর জন্যই হয় যে আজ সাথে কেউ নেই। গাবতলী গিয়ে সিট পাই, বসি। বসেই নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে পোস্ট দিইÑ
‘মা-বাবার কাছে আসতে বাসে সিটের প্রয়োজন পড়ে না। একটু দাঁড়ানোর জায়গা পেলেই হয়।’
সাভার থানা বাসস্ট্যান্ডের কাছে গিয়ে মাকে কল করি। মা আর নাজু আপা তখন সিটি সেন্টারে শপিং করছে। আমিও সিটি সেন্টারের সামনে নেমে যাই। তাদের সাথে শপিংয়ে ঘুরছি। মা কিছু গিফটের শাড়ি কিনবে বলে দোকানে ঢোকে। সাথে আমি আর নাজু আপাও। তারা একপাশে শাড়ি দেখছে, আমি অন্য পাশে চুপ করে বসে আছি। ঠিক আমার বয়সীই একজন মা এলেন, দোকানদারকে বললেন,
-- আমাকে সবুজ শাড়িটাই দিন, লাল শাড়িটা বাইরে নিয়ে খুলে দেখি অনেক বেশিই লাল।
আমি তার দিকে তাকাই। দুটো শাড়ি দেখেই মনে হয় লাল শাড়িটাই তাকে খুব মানাবে। চুপ না থেকেই বলি,
-- লালটাই বেশি মানাবে আপনাকে।
-- আমিও জানি, কিন্তু বিষয় হলো আপা, মেয়ে বিয়ে দিয়েছি, এখন এমন লাল পরব।
-- আরে বলেন কি? আমিও মেয়ে বিয়ে দিয়েছি দুই মাস আগে। মেয়ে বিয়ে দিয়েছি বলে কি আমরা লাল শাড়ি পরব না। আমরা কি বুড়ি হয়েছি।
কথা শুনে তিনি হাসলেন, আমি আবারো তাকে অভয় দিলাম লালটা নিতে। তখনই আপা পেছনে তাকায়, আপাও লাল শাড়ির কথা বলল। তিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দুই পাশে দুই শাড়ি ধরে দেখছেন। বুঝতে পারি তারও লাল শাড়িটা পছন্দ। লাল শাড়িটার দিকে তাকিয়েই একটা মিষ্টি হাসি দেন। দুই কাঁধে দুই শাড়ি নিয়ে আমার কাছাকাছি আসেন, বলেন-
-- আপা চাকরি করিতো, তাই ভাবছি লাল শাড়িটা নেয়া ঠিক হবে কিনা।
-- নিশ্চয়ই ঠিক হবে, আপনি এটা পরেই অফিসে যেতে পারবেন।
কথা শোনার পর তিনি লাল শাড়িটা নিয়ে সবুজ শাড়িটা রেখে দিলেন। লাল শাড়িটা গায়ে দিয়ে আয়না দেখছেন, এদিক ওদিক করছেন। আমি তার অবস্থা দেখছি বসে বসে। নিজেই বুঝতে পারছেন লাল শাড়িটায় তাকে বেশ লাগে, লাগে বলেই তিনি মিটিমিটি হাসছেন। আয়না দেখছেন বার বার। আনন্দের মাঝে হঠাৎ তিনি কই যেন হারিয়ে যাচ্ছেন। একটু পর দেখি অল্পবয়সী এক মেয়ে এসে দাঁড়ায়। আমি নিজেই বলিÑ
-- আপা এত কিছু ভাবার নেই, এটাই নিয়ে যান।
তিনি আবার এগিয়ে আসেন আমার কাছে, বলেনÑ
-- আসলে আপা ওর বাবা নেই তো, তাই ভাবছি লাল শাড়িটা পরা ঠিক হবে কিনা।
তার কথায় আমি চুপ হয়ে যাই। কারণ এরপর বলার কী আছে আমার। দেখছি তার মুখটা পুরোই অন্ধকার হয়ে গেছে। অল্পবয়সী মেয়েটা এগিয়ে আসে আমার কাছে,
-- আন্টি দেখেন না, আম্মুকে কতবার বলছি লাল শাড়িটা নিতে কিন্তু নিবেই না। আসলে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই মা কেমন জানি হয়ে গেছে।
কিছুই বললাম না আর, তিনি সবুজ শাড়িটাই নিলেন। মনে মনে ভাবলাম আমরা মেয়েরা হয়তো এমনি, নিজেকে খুশি করার চেয়ে অন্যকে খুশি করতে, অন্যের পছন্দকে মূল্যায়ন করি বেশি। একটি পরিবারের বাবা এমনিই, তিনি থাকলে সব কিছুই রঙিন আর তার অবর্তমানে রংগুলো হয়ে যায় বর্ণবিহীন।


আরো সংবাদ



premium cement