কেদারা সমাচার
জীবনের বাঁকে বাঁকে- রহিমা আক্তার মৌ
- ২৩ জুন ২০১৯, ০০:০০
স্কুল জীবনে কাঠের চার কোনার টেবিলটা ছিল চৌকির পাশে। চার ভাইবোনের দু’জন বসতাম চৌকিতে আর দু’জন দুই কাঠের কেদারায়। সেই কাঠের হাতলবিহীন কেদারা। এক টেবিলেই চারজনের পড়ালেখা। কলেজ জীবনে সেই চার কোনা টেবিলের দুই পাশে দুই কেদারায় দুই বোন বসে পড়তাম। বিয়ের পর নিজের সংসার, খুব মনে পড়ে ইকবাল ওর ব্যাচেলার বাসা থেকে চার কোনার একটা কাঠের টেবিল নিয়ে আসে। সাথে সেই হাতলবিহীন কাঠের একটা কেদারা। এই কেদারায় বসেই পড়ালেখা, ইকবালের প্রাইভেট কাজ (বাড়ির ড্রয়িং ডিজাইন) করতাম। রোজ অফিস থেকে আসার সময় ইকবাল কাজ নিয়ে আসত, রাতে আমায় বুঝিয়ে দিতো। দিনে আমি তা করতাম।
সংসার একটু বড় হচ্ছে, মাস কয়েকের মাঝে দু’জনের পরিবারে যোগ হয় দেবর টিটু। এক কেদারায় আর চলে না। টিটুকে স্কুলে ভর্তি করালাম। ইকবাল দুটি গদিওয়ালা কেদারা নিয়ে আসে। একটা হাতলওয়ালা, আরেকটা হাতল ছাড়া। আমার খুব আনন্দ, বাসায় গদিওয়ালা কেদারা এসেছে। চার কোনার টেবিলে হাতল ছাড়া কেদারায় বসে টিটু পড়ত। একটা ড্রইং টেবিল কেনা হয়, সেখানে ইকবাল বসত হাতলওয়ালা কেদারায়। আমায় কাজ বুঝিয়ে দেয়ার সময় আমি সেই কাঠের কেদারায়। আমি অপেক্ষায় থাকতাম সেই হাতলওয়ালা গদি কেদারায় বসার। বিষয়টা এমন যে হাতলওয়ালা গদি বসানো কেদারাটি বসের, হাতলবিহীনটা ছোট মিয়ার আর আমি তো....
দিনে আমি সেই হাতলওয়ালা গদি কেদারায় বসে কাজ করতাম, নিজেকে বস বস লাগত। অফিস আদালতে আমার তেমন যাওয়া-আসা নেই। অফিসে চালু হলো চাকার ওপর ঘুরানো কেদারায়। মাঝেসাজে কোনো অফিস গেলে আমি চাকাওয়ালা ঘুরানো কেদারার দিকে তাকিয়েই থাকতাম। খুব ইচ্ছে করত একটু বসে এপাশ ওপাশ ঘুরি। কিন্তু ভয়ে তা পারতাম না। কারণ ততদিনে আমি লম্বা হালকা পাতলা মেয়েটি দুই সন্তানের মা। শুধু মা নয় মোটা হয়ে যাই। ওই ঘুরানো কেদারায় বসার কথা ভাবলেই মনে হতো বসলেই কেদারা ভেঙে যাবে। বড় বড় অফিসে, মোবাইল সিমের কাস্টমার কেয়ারের ছোট উঁচু ঘুরানো কেদারাগুলোতে বসার কত ইচ্ছে, কিন্তু ওই যে ভয়। কাস্টমার কেয়ারের লোকগুলো কী সুন্দর করে বলতÑ
‘ম্যাডাম প্লিজ বসেন।’
আমি কিছুই বলতাম না, ওই দামি ঘুরানো কেদারা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতাম।
দুই সন্তান বড় হলো, প্রায় কুড়ি বছর সেই দুই গদিওয়ালা কেদারা আমার বাসায়, এর মাঝে কয়েকবার গদি চেঞ্জ করা হয়। নিয়মমতো দুই সন্তান দুই কেদারায় আলাদা টেবিলে বসে পড়ে। ইকবালের রাগ উঠলেই কিছু না কিছু ভাঙ্গার অভ্যাস। বসের চেয়ার যেটা, সেটার ওপর দুইবার ইকবালের রাগের পরিসমাপ্তি ঘটে। এতে করে সেই কেদারায় অবস্থা অনেকটা আমার ভাঙা কোমরের মতো। ইকবাল ঠিক করে নতুন কেদারা কিনবে। লিজা আমার ছোট সন্তান, ওর আবদার একটা ঘুরানো কেদারার। কেদারা কিনতে যাওয়ার সময় বারবার বলেছে,
‘মা আমার জন্যে ঘুরানো কেদারা আনবে।’
বড় সন্তান লাইজু বারবার না বললেও কানের কাছে ঠিক এসে বলেছে ঘুরানো কেদারার কথা।
দোকানে গেলাম আমি আর ইকবাল। আমার মনে পুলকিত ভাব, এবার নিশ্চই লিজার চাওয়ায় ঘুরানো কেদারায় বসতে পারব। ঘুরানো ভালো একটা কেদারার দাম সাত হাজার থেকে দশ হাজার। অনেক ঘুরে ইকবালকে পরামর্শ দিই,
‘এতই যখন দাম দুই রকম দুইটা কিনো। দু’জনে ভাগাভাগি করে বসবে।’
আর নিজে ভাবছি ওরা যখন স্কুল কলেজে থাকবে আমি বসব। আমার কারণে কেদারার সমস্যা হলে কেউ তো বুঝবেই না যে আমিও বসেছি। আসলে আমার কারণে ক্ষতি হলে কেউ কিছু বলবে তা নয়, এটা আমার ভাবনাই ছিল।
ইকবাল অবশেষে দুইটা ঘুরানো কেদারা কেনে পনেরো হাজার টাকা দিয়ে। আমার মনে খুব আনন্দ। বাসায় আনার পর লিজা আর লাইজু দু’জনেই খুব খুশি। এখন ওরা বাসায় থাকলেও আমি বসি, মাঝে মাঝে দুই পা শূন্যে রেখে আমি চোখ বন্ধ করে হালকাভাবে অল্প অল্প ঘুরি। অন্য রকম একটা আনন্দ পাই। স্বভাবগত দিক থেকে আমি কারো ওপর ভরসা বা নির্ভর করতে পারি কম। কিন্তু কেদারায় বসে যখন আমি মৃদু ঘুরি, মনে হয় আমি আসলেই শূন্যে ভাসি। কিছুক্ষণের জন্য হলেও ওই কেদারায় ভরসা করি। নিজের দায়িত্ব ছেড়ে দিই ওর ওপর।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা