২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বর্ষা ও সেই মেয়েটি

চারাগল্প
-

বর্ষা এলে মনে পড়ে তোমার কথা! তোমার আর আমার অতীত স্মৃতিগুলোর কথা। জানি তুমি বড্ড সুখে আছো! তোমার স্বামীর সংসার আর ফুটফুটে বেবিকে নিয়ে। ভুল করেও মনে পড়ে না স্মৃতির দেয়ালিকায় তোমার আর আমার স্বপ্নিল সেই সময়গুলো! আচ্ছা নিরা, তোমার কি মনে পড়ে! তুমি আর আমি সেই প্রাইমারি স্কুল থেকে একসাথে পড়ালেখা করে এসেছি। প্রাইমারি স্কুল থেকে হাইস্কুল লাইফ, আমরা একসাথেই কাটিয়েছি। তোমার কি মনে পড়ে! ক্লাস ওয়ান থেকে তোমার আর আমার রোল পাশাপাশি থাকত সব সময়। আমার দুই রোল হলে, তোমার হতো তিন রোল। কি অবাক করা, তাই না! স্কুলের স্যার-ম্যাডাম আর ক্লাসমেট, সবাই তোমাকে আর আমাকে নিয়ে সব সময় হাসিঠাট্টা করত। টিফিন সময় আমরা রোজ একসাথে খেলতাম, টিফিন খেতাম ভাগ করে। মাঝে মধ্যে ক্লাসে স্যার কোনো প্রশ্ন করে বসলে আমরা দু’জনই একসাথে উঠে দাঁড়াতাম আর উত্তর দিতাম।
ক্লাসমেটরা মাঝে মধ্যে তোমাকে আর আমাকে জড়িয়ে কত আজেবাজে কথা বলত! অথচ ওদের কথাগুলো একটুও কানে নিতাম না আমরা।
স্কুল লাইফে আমার বেস্ট বন্ধু ছিলে তুমি। একদিন যদি আমাদের দু’জনের কেউ একজন স্কুল না আসতাম, তবে খুব কষ্ট হতো। মনটা ভীষণ খারাপ হতো; তবে কেন এমন হতো সেই প্রশ্নর উত্তর কখনোই খুঁজে পাইনি, না তুমি না আমি। তোমার আর আমার এক গ্রামেই বাড়ি। তোমার ছিল গ্রামের প্রথম মাথায় আর আমার শেষ মাথায়। রোজ স্কুলে যাওয়া-আসার পথে আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে তুমি। আচ্ছা নিরা, তোমার কি মনে পড়ে! বর্ষা এলে তুমি আর আমি এক ছাতার নিচে দু’জন মিলে হেঁটে স্কুলে যেতাম। স্কুলের উঠোনে বিশাল বড় একটা কদমগাছ ছিল। বর্ষা এলে কদমগাছে ফুটে থাকত কদম ফুল! বৃষ্টির দিনে তুমি আমার কাছে বায়না ধরতে কদম ফুল পেড়ে দিতে। আমিও মনের আনন্দে তোমার আবদার পূরণ করতাম। কদম ফুল পেয়ে তোমার চোখেমুখে সে কি আনন্দের ঝিলিক! বর্ষা দিনে মাঝে মধ্যে দু’জনের কেউ ছাতা নিয়ে স্কুলে যেতাম না। স্কুল ছুটির সময় হঠাৎ করে বৃষ্টি এলে ব্যাগের ভেতর বই ভরে, গায়ের শার্ট খুলে তোমার মাথা ঢেকে দিতাম। কাকভেজা হয়ে দু’জনে বাড়ি ফিরতাম। বৃষ্টির পানি যখন তোমার কালো চুল আর ধবল মুখ অবয়ব চুয়ে চুয়ে পড়ত। তখন আমার মনে হতো আমি যেন এই মুহূর্তে স্রষ্টার স্বর্গের হুরের সাথে চলছি। বেশ ভালো চলছিল তোমার আর আমার স্কুল লাইফ। ভালোবাসা বলতে কী, তখন তুমি আর আমি আমরা কেউ ঠিকভাবে বুঝতাম না। তবে আমার কেন যেন মনে হতো, একদিন তোমার সাথে কথা না হলে, দেখা না হলে, আমার কিছুই ভালো লাগতো না। তোমার বেলায়ও না কি ঠিক এমনটাই হতো। কোনো একদিন গল্পের এক ফাঁকে বলেছ আমাকে। তবে সুন্দর মুহূর্তগুলো না কি খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়! হঠাৎ করে একদিন তুমি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করলে। একদিন দু’দিন করে এক সপ্তাহ চলে গেল। তবে তুমি আর স্কুলে এলে না।
পরে আমি একদিন তোমার বাড়িতে খোঁজ নিতে গেলাম। তোমার মুখে যা শুনলাম তার জন্য একটুও প্রস্তুত ছিলাম না। তুমি বললে, আগামী রোববার তোমার বিয়ে। ছেলে না কি অনেক ভালো! ঢাকা শহরে কী যেন একটা চাকরি করে। তোমার গরিব রাজমিস্ত্রী বাবা তাই তোমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে। কারণ, গরিব মানুষ বলে কথা, এমন ঘর হয়তো আর নাও আসতে পারে। সেদিন তোমার কথা শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল। অশ্রুসজল চোখে তোমার বাড়ি থেকে চলে এলাম। কয়েকদিন স্কুলে যাওয়া বন্ধ করলাম। নাওয়া-খাওয়া সব কিছু ভুলে গেলাম, কেন এমন হলো নিজেও বুঝলাম না। তবে একজন ভালো বন্ধু যে হারিয়ে ফেলছি, সেই যন্ত্রণা আমি পাচ্ছি। অবশেষে এলো সেই বিশেষ দিন রোববার। সেদিন সারাদিন কান্না করছি, আমার সাথে আকাশও মনে হয় সেদিন কান্না করছিল। সেই রোববার ছিল আষাঢ় মাসের কোনো এক রোববার। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে, শেষ বিকেলে বন্ধুদের সাথে তোমার বাড়িতে গেলাম। তোমার বিয়ের দাওয়াত খেতে। সবাই মিলে বসলাম তোমার আর তোমার বরের পাশে। লাল শাড়িতে তোমাকে বেশ মানিয়েছে। দেখতে যেন লাল টুকটুকে এক পরী! একসময় বিয়ের সব আয়োজন সম্পন্ন হলো। এবার তোমাকে বিদায় দেয়ার পালা। একে একে সব বন্ধু কথা বলল তোমার সাথে। শুধু আমি পারলাম না কথা বলতে, বুকের ওপর কে যেন বড্ড বড় একটা পাথর তুলে দিয়েছে আমার। দু’চোখের জল ঝরিয়ে বাড়িতে চলে এলাম। সেদিনের পর থেকে আমার জীবনজুড়ে কেমন যেন একটা শূন্যতা অনুভব করি। জানি তুমি খুব সুখে আছো! এখন বর্ষা এলে হয়তো তোমার স্বামীর হাত ধরে চলো, এক ছাতার নিচে। কদম কিংবা কেয়া ফুলের আবদার করো স্বামীর কাছে।
নিরা তুমিও কী আমার মতো অতীত ভাবো? আষাঢ় যে আবার এলো।
সফিপুর, গাজীপুর


আরো সংবাদ



premium cement