১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দুশমন

বাবা দিবস
-

জন্মগতভাবে বাবার সাথে আমি রক্তসূত্রে আবদ্ধ হলেও কখনো তাকে বলতে পারিনিÑ ‘তোমাকে আমি বড় শ্রদ্ধা করি’, ভালো আছো তো বাবা!’ কিংবা তার ১০১ ডিগ্রি জ্বরের সময় তিনি যখন উষ্ণ কম্বলে গা মুড়িয়ে ঠকঠক কাঁপছেন আর জ্বরের ঘোরে রাস্তার মোড়ে উদ্দেশহীন দাঁড়িয়ে থাকা ওই উন্মাদের মতো আবোল-তাবোল বকছেন, তখনো তাকে বলতে পারিনি ‘শরীর কেমন লাগছে এখন?’
আমার কাছে বাবা মানে ‘অন্য মানুষ’। হিংস্র এক গর্জনীয় জন্তু। সেই হিংস্রতায় গর্জে উঠতে উঠতে বাবা অনায়াসে হয়ে ওঠেন আমার দুশমন। জীবন আর সম্পর্কÑ এ দু’টি বিষয়ের তাৎপর্য বুঝে ওঠার পর বাবা নিত্যকাল আমার কাছে দুশমনের পরিচয়ে নিজেকে নিকষ অচিন আঁধারে তিমিরাচ্ছন্ন করেছেন বহুবার। সব কিছুর উৎসর্গ ছিল ‘শাসন’ নামের উল্কাটি।
শাসনÑ এই অহমিকায় বাবা তার এই সন্তানের সাথে গড়েছেন ভয় আর ঘৃণার পিঙ্গল দেয়াল। সে দেয়ালের অপর প্রান্তে নিভৃতে দাঁড়িয়ে এতটা কাল তাকে ভয়ের চূড়ান্তে রাখতে গিয়ে প্রতিনিয়ত টের পেয়েছি, তাকে কখনো আমি ভালোবাসতে পারিনি। শিথিল আবেগে গলে গিয়ে ছুটে গিয়ে বলতে পারিনিÑ ‘এসো, আজ আমরা পাশাপাশি বসে ভারত-বাংলাদেশের খেলা দেখব।’
আমার শৈশবের শুরুতে বাবা ছিলেন প্রবাসী। কয়েক বছর পরপর মহা আয়োজনে বিদেশ থেকে আসতেন। অন্য সন্তানদের যেখানে প্রবাসী বাবাদের প্রত্যাবর্তনে আনন্দ-উদ্বিগ্নতা থাকেÑ ‘আহা, কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে’ টাইপের; সেখানে প্রবাসী বাবার আগমনে আমি বিশ্বভুবনের দুশ্চিন্তা নিয়ে নেতিয়ে পড়তাম। যদিও বাবা তার এই সন্তানের জন্য চকলেট, হাতঘড়ি, কলম, ভিডিও গেমসহ দুনিয়ার কী সব খেলনা নিয়ে হাজির হতেন। সেসব দেখে আমার বোধ পুলকিত হতো সত্য, কিন্তু মন থেকে তার প্রতি আজন্মের যে অদৃশ্য বেড়াজাল, আমি সে বেড়াজালের আড়ালে ভয়ে মরা রোদের মতো বিবর্ণ হয়ে থাকতাম।
একদিন প্রবাসী বাবা জানালেন, তিনি আর বিদেশ করবেন না। দেশেই বড় কোনো ব্যবসা নিয়ে বসবেন। শুনে আমি মনে মনে মরে যাই।
দিন দিন বাবা হয়ে উঠলেন আমাদের ঘরের মানুষ। পড়তে বসার উঁচু ধমক, ফুটবল নিয়ে মাঠে যাওয়ার তিক্ত বাধা, স্কুল পিকনিকে শরিক হতে না পারার ভয়াল যন্ত্রণা, রোজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে মক্তবে যাওয়ার তার আগমনী কণ্ঠ দিন দিন আমাকে কী নিদারুণ করে হাঁপিয়েই না তুলেছে। সব মিলিয়ে কোন ফাঁকে যে বাবা আমার দুশমন হয়ে উঠলেন। তবু সেই দুশমনের সাথে একই ছাদের তলায় বাস, পাশাপাশি রুমে রাতের পর রাত পার করা, তিতা করলা সবজিতে অনীহা থাকার পরও তার সামনে বসে চুপচাপ সেটাকে ভাতের লোকমায় ভরে গলা দিয়ে নামিয়ে দেয়ার জ্বালাময় কর্তব্য পালনে মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হতো, এই ঘর ছেড়ে দূরের কোনো একাকী নিভৃতে চলে যাই। আর যেন ফিরে না আসি এই গৃহদাহে।
ঘর। না, আমাদের এই স্বপ্নময় ঘর ছেড়ে আজো কোথাও চলে যেতে পারিনি নীরব এক অভিমানে। বেলা শেষে সাঁঝের আগমনে এই ঘরই যে দীর্ঘকাল ধরে আমাকে কেবল টানছে। তাই ঘরকে ছেড়ে পরকে আর টানতে পারিনি কখনো।
বড় হওয়ার সাথে অনুভব করি আমার প্রতি বাবার দৃঢ় শাসন ক্রমেই বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছি আমি। দাড়ি-গোঁফ ওঠা নাবালক ছেলেকে বাবা আর আঙুল তুলে রাগ দেখান না। তেজিগলায় তিনি খুব কম বলেন ‘এতক্ষণ ঘুমিয়ে কেন? বেলা কয়টা বাজে, খেয়াল আছে?’ শাসনের মাত্রা হয়তো কমেছে, কিন্তু শোষণ কমেনি। ভিন্ন কায়দায় তিনি তার এই সন্তানকে শোষণের শেষ সীমানায় রাখেন। হয়তো এ কারণে ক্লাসের বাংলা পরীক্ষায় ‘প্রিয় ব্যক্তিত্ব’ রচনায় বাবাকে নিয়ে লিখতে পারিনি। অনেক রাতে ঘরময় তার অনুপস্থিতিতে একটি ফোনকল করে জানতে চাইনি ‘কোথায় তুমি, ফিরছো না কেন, রাত বাড়ছে।’ সময়ের গাঢ়ত্বে কেবল তার সাথে আমার যে জিনিসটি ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলে, তার নাম দূরত্ব।
আমার মনে পড়ে, সে এক অন্য দিনের কথা। শৈশবের পরম সঙ্গী সাইকেল চালিয়ে সেই পড়ন্ত দুপুরে প্রাইমারি থেকে ফিরছি বই-খাতা ছুড়ে ফেলে পদ্মপুকুরে ঝাঁপ মেরে বাঁধ না মানা সাঁতার কেটে ক্লান্ত হবো বলে। এসব ভাবতে ভাবতে আমার শক্তিময় তরুণ দুই পা যখন সাইকেলের দুই প্যাডেলে দুরন্ত গতিতে চেপে বাড়ির সন্নিকটে, তখন ঘটে অঘটন। দ্রুতগামী বেবিট্যাক্সির মুখোমুখি সংঘর্ষে আমি যখন ছিটকে পড়ি ইট বিছানো দীর্ঘ দিনের চেনা লম্বা রাজপথে, মাথা প্রচণ্ড জখম হয়ে জ্ঞান হারানোর আগে মনে আছে লাল রক্তের স্রোতে আমি লুটিয়ে পড়েছি।
জ্ঞান ফিরেছে দুই দিন পর। চেয়ে দেখি আমি এক অন্য পরিবেশে। হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে আছি মাথায় সাদা ধবধবে ব্যান্ডেজ নিয়ে। ডাক্তার বাবু জানালেন, প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। রক্তের প্রয়োজন ছিল। কোথাও রক্ত পাওয়া যাচ্ছিল না। হন্যে হয়ে সবাই যখন রক্তের খোঁজে দায়িত্ববান হয়েছে, বাবা তখন ডাক্তার বাবুকে জানালেন তিনিই রক্ত দেবেন।
‘তোমার বাবা তোমাকে দুই ব্যাগ রক্ত দিয়েছে’Ñ ডাক্তার বাবুর এই কথায় মুমূর্ষু সেই আমার চোখে পানি চলে এলো। যাকে দুশমন ভেবে বুকের নরম পৃথিবীতে জমা করে রেখেছি অবিনাশী ঘৃণা, সেই দুশমনই আমাকে রক্ত দিয়ে...। আচ্ছা দুশমনরা কখনো রক্ত দেয়?
না, দেয় না। বাবারা কখনো সন্তানের দুশমন হয় না। হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে রুগ্ণ সেই আমি সেদিন এ চরম সত্য মেনে নিয়েছি যে, বাবারা কেবল বাবাই। দুশমন নয়।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী


আরো সংবাদ



premium cement