১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আমার প্রিয় বাবা

বাবা দিবস
-


Ñ বাবা, কালকে ঢাকা যাইবা?
Ñ হ্যাঁ, যাবো তো।
Ñ বাবা, আমার জন্য একটি ফুটবল আনবা কিন্তু।
Ñ ঠিক আছে আনব, বড় না ছোট?
Ñ মাঝারিটা আইন্নো কেমন।
বাবার সাথে ঘুমানের আগে আমার এসব নিত্যনতুন বায়নাবিলাস বলা যায়। বাবা আসতে দেরি হওয়ায় আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোরে দেখি আমি বাবার বুকে শুয়ে আছি। আর চোখ খুলতেই দেখি আমাদের ঘরের বাঁশের তীরে আমার নতুন ফুটবল ঝুলছে। আমার ছেলেবেলার আনন্দ-দিনের মধ্যে এটি একটি। আমার বাবা জুতার ব্যবসা করতেন। স্কুল ছুটি দিলে প্রায়ই আমাকে তার সাথে দোকানে নিয়ে যেতেন। আর সারা দিন চলত আমার বায়নাবিলাস, আম খাবো, জাম খাবো এবং আরো কত কী! বাবা ঢাকা গেলেই আমার জন্য একটি হাফশার্ট নিয়ে আসতেন আর এটা দোকানে যেদিন যেতাম সেদিনই আমাকে দিয়ে বলতেনÑ ‘তোর মা জিঙ্গাইলে কবি মামা কিন্না দিছে।’
ক্লাসে প্রথম হই বলে বাবা সবার আগে নতুন জামা আর ইংলিশ প্যান্ট বানিয়ে দিতেন। রেজাল্ট বের হওয়ার আগেই স্কুলের লাইব্রেরি থেকে নতুন ক্লাসের নতুন বই নিয়ে আসতেন। নতুন বইয়ের গন্ধে আমার কৈশোরের বাঁদরামি আরো বেরে যেত। অন্যায় আবদার করতে গিয়ে অভিমানও করতাম অনেক। মাঝে মধ্যে ক্ষুদ্র বিষয় নিয়েও তার সাথে রেগে যেতাম, যা আজো ভাবলে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। আমাদের পরিবারের সুখের জন্য এখনো বাবা নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছেন। এখনো আমি বাড়ি থেকে কোথাও বেরোলে বলে বসেনÑ ‘ছাতাটা নিয়ে যা, যা রোদ পড়ছে এবার! চুল-দাড়ি একটু বড় হলেই বাড়িতে গেলে জবাবদিহি করতে হয়, এখনো কাটলাম না কেন? জামাটা ইস্ত্রি করা হয়নি কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তার স্বাস্থ্যের অবস্থা ভালো নয়, কিন্তু আমার কিছু হলে একেবারে দিশাহারা হয়ে যান, বাবার ছেলের প্রতি এই আন্তরিকতা দেখে আমি ফিফটি পারসেন্ট ভালো হয়ে যাই। এখনো খরচের ব্যাগ বয়ে বেড়ান। তার ধারণা তিনিই যেমন থাকেন না কেন, তার ছেলেমেয়েরা টাটকা খাবার খেতে পারে। আমি মাঝে মধ্যে বাবাকে ফোন দিই
Ñ ‘বাবা, খরচের ব্যাগ আছে আজকে?
Ñ আছে তো, তুই রিকশা করে বাড়িত যা, আমিই নিয়ে যাবো। যাওয়ার সময় বাতেনের দোকান থেকে একটা ডাব খেয়ে যাইছ।
আমি ভাবি, এ মানুষটি আসলে কী! আমি এখন পর্যন্ত তার কোনো দোষ খুঁজে পাইনি আমার জন্মের পর থেকে।
আমাদের দোকান পুড়ে যাওয়ার পর বাবা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি, কিন্তু বাজারে থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে, তাই একদিন আমাকে বলল
Ñ আমাকে একটি কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারবি?
Ñ কেন বাবা? কী হয়েছে?
Ñ কিছু না, আমার বাড়িতে ভালো লাগে না তাই।
বাবার ভালো লাগা দিয়ে কথা। বাবা যেহেতু জুতা ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন; তাকে আমাদের এক আত্মীয় কথায় কথায় তার দোকানে বসতে বলেছিল। বাবার সাফকথা, তার ছেলের অনুমতি লাগবে। বাবার মনের অবস্থা চিন্তা করে অনুমতি দিয়ে দিলাম। লোকে যে যাই বলুক-ভাবুক, আমার বাবা ভালো থাকুক। সেদিন আমি কষ্টও পেয়েছিলাম খুব। সে দোকানে আমি প্রায়ই যাই বাবার সাথে দেখা করতে। খরচের ব্যাগ বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই। তিনি বারণ করেন, কিন্তু ভাবি বাবা আর কত করবেন আমাদের জন্য! খরচের ব্যাগটা দিলেও বলে দেবেনÑ ‘রিকশা করে যাইছ, হেঁটে যেতে পারতি না’। একদিন বাবাকে বললাম
Ñ বাবা, তোমার সাথে একটা ছবি তুলব।
Ñ আরে না, ময়লা জামা পরে আছি। এখন কী ছবি তুলবি?
Ñ তুমি ক্যাশে বসো তো বাবা, কোনো সমস্যা নেই।
বাবার সাথের আরেকজনকে বললামÑ একটা ছবি তোলেন তো দেখি। তখনই আলামিন কয়েকটি ছবি তুলে দিলেন।
এখনো বাড়িতে গেলে বাবা প্রথমেই জানতে চান আমি খেয়েছি কি না। আর না খেলেও কেন খাবো নাÑ নানা ধরনের জবাবদিহিতা। বাবা, তোমার মতো এমন বাবা কি আর কারো আছে? আমার মনে হয় না বাবা। তোমার মতো কি তার ছেলের জ্বর হলে এমন মমতায় পানি ঢেলে দেয়? কখনো না। বাবা এ পৃথিবীতে শুধু তুমি একজনই বাবা আমার, যে কিনা তার ছেলের সব চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে মানুষের কাছে হাত পাততে দ্বিধা করত না।
নোয়াগাঁও, দেবিদ্বার, কুমিল্লা


আরো সংবাদ



premium cement