২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

  সিগারেট চা রা গ ল্প

-

এবারের ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসে দেখি সবার জন্য ঈদের জামা কেনা হয়েছে কেবল বাবা ছাড়া। বাবার জন্য মা কোনো কিছুই কেনেননি। অবশ্য তার কারণও ব্যাখ্যা করে মা বললেন, ‘তোর বাবা যেদিন সিগারেট ছাড়বে, সেদিন আমার কাছ থেকে ১০টি গোলাপ পাবে। তার আগে একটু দয়াও পাবে না।’ এই হলো মূল কাহিনী। আমি ঘরের বড় ছেলে। চাকরি করি ঢাকায়। তিন ছেলে এক মেয়ে আর ধূমপায়ী স্বামীকে নিয়ে মায়ের সাজানো সংসার। সে সংসারে বাবা অনেকটা পরিত্যক্ত বলা চলে তার ধূমপানের কারণে।
রাহী ঈদে দু’টি শার্ট পেয়ে আনন্দে রমরমা। রকি ঈদের দিনে ওর প্রিয় নীল পাঞ্জাবি পরে কোন পোজে ছবি তুলে ফেসবুকে ছাড়বে, সেটি নিয়ে আপাতত ব্যস্ত। আমার বোন মিম কোন পার্লারে গিয়ে ঈদের সাজ সাজবে, তা নিয়ে বান্ধবীদের সাথে ফোনকলে মগ্ন। আর বাবা! যার প্রতি মায়ের ধূমপানের চিরন্তন অভিযোগের কারণে এবারের ঈদে কিছুই কেনেননি, সেই মানুষটি উঠোনের পাশে আমতলায় নিরিবিলি সিগারেট টানছেন। বাবা আমাকে দেখতে পেয়ে হেসে উঠে বললেন, ‘খোকা, কখন এলি? আয় আমার কাছে।’ বাবার কাছে যেতেই বাধা দিয়ে মা কড়া গলায় বললেন, ‘খবরদার, আমার ছেলেকে ডাকবে না। তুমি বিড়ি নিয়েই থাকো।’ স্ত্রীর কটুকথায় বাবা হাসলেন শুধু। সে হাসিতে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম অনুশোচনা। হয়তো সিগারেটের নেশা থেকে বাবার আর মুক্তি নেই বলে অনুশোচনা ঢেলে দিলেন মুখের হাসির আড়ালে।
রাতে জানলাম বাবাকে ঘরেও থাকতে দেয়া হয় না। ঘুমন্ত বাবার দম ওঠানামার সময় মুখ থেকে নাকি সিগারেটের বিশ্রী গন্ধ বের হয়! অবহেলিত বাবা তাই বারান্দায় মাদুর পেতে ঘুমান। ঘুমানোর আগ পর্যন্ত তার আঙুলের ফাঁকে জ্বলতে থাকে সিগারেট। এই সিগারেটের জন্য মায়ের সাথে তার দফায় দফায় ঝগড়া চলে। সংসারে অশান্তি বাড়ে। তবুও নিরুপায় বাবা ধূমপানের নেশা থেকে ফিরে আসতে পারেন না। অসৎ বন্ধুর পাল্লায় পড়ে অনেক বছর আগে সিগারেটের কাছে নিজেকে বলি দিয়েছেন।
২.
ঈদের নামাজ শেষ করে ছোট দুই ভাই রাহী আর রকির সাথে যখন কোলাকুলি করে ঈদগাহের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি, বাবা কোথা থেকে উড়ে এসে আমাকে বললেন, ‘খোকা, আমার সাথে কোলাকুলি করবি না? আয়।’ আমি হেসে বাবার সাথে কোলাকুলি করলাম এবং বাবার মুখ থেকে সিগারেটের অসহনীয় বিশ্রী গন্ধে আমার বমি আসতে চাইল। বাবা সম্ভবত সেটা টের পেয়ে আমার থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন যে, আমি একেবারে লজ্জায় পড়লাম। হঠাৎ বাবার গায়ে পুরনো শার্ট দেখে বুকটা কেমন করে উঠল। বাবার জন্য ঈদে কোনো জামাই কেনা হয়নি। অথচ আমরা তিন ভাই নতুন জামা পরে তার সামনে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছি। আমার চোখ চলে গেল বাবার শার্টের পকেটের দিকে। ছেঁড়া পকেটে কয়েকটি দুই টাকার জীর্ণ অচল নোট দেখা যাচ্ছে। আমি মানিব্যাগ খুলে বাবার হাতে একটি ৫০০ টাকার কচকচে নোট দিতেই রকি ছোঁ মেরে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘না ভাইয়া, বাবাকে টাকা দিসনে। সব টাকার বিড়ি কিনবে।’ বাবা খুব অসহায় চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
বাড়িতে এসে আমরা যখন মায়ের রান্না করা সুস্বাদু পায়েস সেমাইয়ের মুখরোচক বাটিতে নিজেদের সমর্পণ করেছি, বাবা তখনো উঠোনে চেয়ার পেতে বসে বাতাসে সিগারেটের ধোঁয়া ছড়াচ্ছেন। এমন ঈদের দিনে মা তার স্বামীকে একবাটি সেমাই তো দেননি, বরং আন্দোলিত গলায় গর্জে উঠে বললেন, ‘ছেলেদের সামনে বিড়ি টানতে তোর লজ্জা লাগে না নিমক হারাম?’ বাবা কিছুই বললেন না। শুধু মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। সে হাসিতে কোনো মায়া ছিল না।
৩.
ঈদের ছুটি শেষ। আজ আমি শহরে চলে যাচ্ছি। কাল অফিসে ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান। বিদায় বেলায় মা অঝোরে কাঁদলেন। ভাইবোনদের মন খারাপ। বাবা আমাদের থেকে দূরে জামরুল গাছের তলে দাঁড়িয়ে সিগারেট...। আমি চলে যাচ্ছি দেখে বাবার মন খারাপ কিনা বুঝতে পারছি না।
বাস চলছে। বাসের জানালা গলে বাতাস এসে আমার চুল উড়াচ্ছে। পাশের সিটের শ্যামলা মেয়েটি বারবার আমাকে দেখছে। এতে আমার অস্বস্তি লাগছে। হঠাৎ...। বাস অ্যাক্সিডেন্ট করল। পাশের ক্ষেতে উল্টে পড়ল আমাদের বাস। যেভাবে উল্টে পড়েছে, কারোই বাঁচার কথা নয়। তবুও সবাই বেঁচে আছে। কিন্তু জখম আর আঘাতের ব্যথায় সবার মরি মরি অবস্থা।
আমার আঘাতটা লেগেছে কোমরে। যন্ত্রণায় আমি ঘাসের ওপর পড়ে আছি। কোমরের হাড় ভেঙে গেল কিনা কে জানে! আমার কী হবে এখন! কে সাহায্য করবে! হঠাৎ পকেটের মোবাইলটা বেজে উঠল। এই বিপন্ন বেলায় কার আবার কল? মিথিলার নয় তো! মিথিলার গল্প অন্যদিন বলা যাবে।
যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখি বাবার কল। বাবা সাধারণত আমাকে কখনো কল করেন না। এখন করেছেন কেন? বাড়িতে কারো সমস্যা নয়তো! রিসিভ করতেই ওপার থেকে বাবার দিশেহারা কণ্ঠ, ‘খোকা, এইমাত্র আমার হাত থেকে সিগারেট পড়ে গেল। হাত থেকে কোনো কিছু পড়া খারাপ লক্ষণ। কেন জানি মনে হলো তোর কোনো বিপদ হয়েছে। তুই নিরাপদে যাচ্ছিস তো? বল আব্বা।’
আমার কান্না পেল বাবার কথায়। কী জবাব দেবো বুঝতে পারছি না। কঠিন ব্যথায় আমার কোমর ফেটে যাচ্ছে। এই বিপদের কথা কী বাবাকে বলব? না না, বলা ঠিক হবে না। ওপার থেকে বাবার উঁচু কণ্ঠ, ‘কথা বলিস না কেন, এই খোকা...। খোকা...’
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী


আরো সংবাদ



premium cement