২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

আঁধিয়ার

ঈদ আয়োজন
-

সংসারে তখন আমাদের চরম অভাবের দিন। আব্বা প্রায়ই ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করে ফেলতেন। আম্মার যথেষ্ট বারণ থাকা সত্ত্বেও আব্বাকে বিরত রাখা যেত না। সেগুন কাঠের চেয়ার, স্টিলের আলমারি, সিলিংফ্যান, আম্মার পোষা হাঁসগুলো আব্বা অবলীলায় বিক্রি করে দিতেন অভাবের তাড়নায়। আমাদের নিত্য ব্যবহৃত এসব জিনিস বিক্রির পয়সায় অভাব কখনো পুরোপুরি দূর হতো না। সংসারে ঘাপটি মেরে বসা অভাবের সাথে যুদ্ধ করতে করতে আম্মা একদিন মামার বাড়ি থেকে নিয়ে এলেন আস্ত একখানা সেলাই মেশিন। সে দিনই প্রথম জেনেছি বিয়ের আগে আম্মাকে নানাজান সেলাই শিখিয়েছেন আর কিনে দিয়েছেন এই সেলাই মেশিন।
সেই সেলাই মেশিন আমাদের সংসারে জায়গা করে নেয়। সেলাই শিল্পে আম্মার অসাধারণ দক্ষতা তত দিনে প্রতিবেশীদের চোখে পড়ে। ফলে তাদের ব্লাউজ, পেটিকোটসহ অন্যান্য বস্ত্র সেলাইয়ের কাজগুলো আম্মা দিনে দিনে পেতে থাকেন। পারিশ্রমিক হিসেবে যে পয়সা আসত, সেটা দিয়ে সংসারের যাবতীয় খরচে আম্মা খুব দায়িত্বশীল হয়ে উঠলেন।
আম্মার সেই সেলাই মেশিন ধীরে ধীরে আমাদের সংসারে উপার্জনের বস্তু হয়ে ওঠে। ছোটবেলায় ঈদের সময়ে দেখতাম আম্মা দশ গেরামের জামা সেলাইয়ে সকাল-সন্ধ্যা নিবেদিত। ঈদ এলে তার যেন দম ফেলার সময় নেই। সাহ্রি খেয়ে নামাজ শেষে সেলাই মেশিনে বসতেন, উঠতেন দুপুরে। সন্ধ্যার পর আবার বসতেন। আমি আম্মার পাশে দাঁড়িয়ে তার পরিশ্রম দেখতাম। কখনো কখনো আম্মা আমাকে বাজারে পাঠাতেন সুতা কিনে আনার জন্য।
ঈদ যখন ঘনিয়ে আসে, আম্মার ব্যস্ততা ততই বাড়ে। জামাকাপড় সেলাইয়ে আম্মার এই নিরন্তর শ্রম দেখে অবাক লাগত। চোখে মোটা কাচের চশমা পরে সেলাই মেশিনে বসতেন আর তার সবল দু’টি পা নিরলস চাপত সেলাই মেশিনের প্যাডেল। তার যেন বিরাম নেই। ঈদ যতই কাছে আসে, আম্মার শ্রম ততই বাড়ে। প্রতিদিন প্রতিবেশীরা কাপড় নিয়ে আসত তাদের ঈদের জামা সেলাই করতে। আম্মা মহা উৎসবে সেই কাজগুলো গ্রহণ করতেন। আম্মাকে তখন প্রায়ই বলতাম, ‘সবার জামা সেলাই করেন। আমারটা কবে করবেন?’ আম্মা হাসতেন। সেই হাসিতে মুগ্ধতা থাকত না। থাকত গ্লানি।
একদিন বাড়ি ফিরে দেখিÑ খান বাড়ির আলমের বউ আম্মাকে অসভ্য ভাষায় গালমন্দ করছেন। আম্মার অপরাধÑআলমের বউয়ের ব্লাউজ তার মনের মতো সেলানো হয়নি। আলমের বউয়ের অযথা অপবাদ মুখ বুজে সয়ে নিলেন আম্মা। কিছুই বললেন না। শুধু তার চোখ দুটো জলে ভরেছে।
সেবার ঈদের মাত্র আর কয়েক দিন বাকি। সেলাই শিল্পে আম্মার বিরামহীন ব্যস্ততা। দুপুরের দিকে তিনি মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে গেলেন। ডাক্তারের কাছে নেয়া হলো। ডাক্তার জানালেন প্যারালাইসিস হয়ে আম্মার দু’টি পা অকেজো হয়ে গেছে। চিরতরে চলে গেছে পায়ের বোধশক্তি।
শেষে আম্মার আশ্রয় হলো হুইলচেয়ারে। সেলাই মেশিনের প্যাডেল চাপা দু’টি পরিশ্রমী পা নির্বোধ হয়ে গেল। এই অপ্রত্যাশিত রোগ তাকে মুক্তি দিয়েছে অন্যের কাপড় সেলাইয়ের দায় থেকে।
২.
হঠাৎ বদলে যেতে থাকে আমাদের পারিপার্শ্বিক সমাজ। ঈদে এখন আর কেউ জামা সেলাই করে না। আধুনিক পরিবেশ শহরের সীমানা ছেড়ে গঞ্জের হাঁটেও গড়ে তুলেছে শপিং কমপ্লেক্স। যারা ঈদে আম্মার কাছে জামা সেলাই করতে আসত একসময়ে, তারা এখন দলে দলে সেসব শপিং কমপ্লেক্সে যায় ঈদের কেনাকাটা করতে। সেলাই জানা আম্মার কাছে এখন আর কেউ আসে না। আগের মতো সেই পুরনো অভাব আমাদের ছোট্ট ঘরে আবার জেগে ওঠে আর বারান্দার এক কোণে চুপচাপ পড়ে থাকে আমার আম্মার জং ধরা একখানা সেলাই মেশিন। আম্মা কাতর চোখে সেই সেলাই মেশিনের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার চোখে জল আসে কি না বুঝতে পারি না।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী

 


আরো সংবাদ



premium cement