২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সুই-সুতায় স্বপ্ন আঁকেন যারা

-

ঈদ সামনে রেখে পাঞ্জাবি, ফতুয়া আর শাড়িতে নকশা ভরাটের (হাতে সেলাই) কাজ নিয়ে শেষ মুহূর্তে ব্যস্ত সময় পার করছেন মানিকগঞ্জ জেলার প্রায় ৪০ হাজার নকশিশিল্পী। তাদের হাতের নিপুণ কাজে প্রায় পাঁচ লাখ পিস বর্ণিল পাঞ্জাবি-ফতুয়া আর শাড়ি সরবরাহ হচ্ছে রাজধানী ঢাকার নামীদামি ব্র্যান্ডের শোরুমগুলোতে। শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ দেশের অন্যান্য জেলা শহরেও যাচ্ছে তাদের কাজ করা পোশাক।
মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সিল্ক, মসলিন ও আদি কর্টন পাঞ্জাবিসহ বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ডের গলা ও হাতের কারুকাজ করা হচ্ছে। আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন, নকশি ও আড়ং ব্র্যান্ডসহ ছোট বড় অন্তত ৪০টি ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবির কারুকাজ করছেন অসচ্ছল পরিবারের এসব নারীশ্রমিক।
জানা যায়, ১৯৮৩ সালে মানিকগঞ্জে শুরু হয়েছিল পাঞ্জাবি-ফতুয়া আর শাড়ির গায়ে সুই-সুতা দিয়ে নকশা বুননের কাজ। শুরুতে আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে দুস্থ নারীদের এ কাজে প্রশিক্ষণ দেয় বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক। নিজস্ব বিপণন কেন্দ্র আড়ংয়ের মাধ্যমে এসব পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি করে সংস্থাটি। এরপর ব্যক্তিগত ও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে শুরু হয় পাঞ্জাবির ভরাট কাজ। এভাবেই গত দুই দশকে এই নকশার কাজে ঘটেছে নীরব বিপ্লব। শুরুর দিকে কাজটিকে ছোট করে দেখা হলেও বর্তমান সময়ে সেই দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই পাল্টে গেছে। সময়ের সাথে অনেক শিক্ষিত তরুণ-তরুণী এ কাজে জড়িয়ে পড়েছেন।
মানিকগঞ্জ শঙ্খনীল ফ্যাশন কারখানার নকশি কারিগর সালমা বেগম জানালেন, সারা বছর নকশা তোলার কাজ করলেও প্রতি বছর ঈদের আগে কাজের চাপ বেড়ে যায় কয়েক গুণ। রোজা শুরু হওয়ার আগে থেকে দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়। এই কারখানার আরেক নকশি কারিগর নাদিয়া জানান, আমাদের হাতে তৈরী পোশাকের কদর আমরা তেমন বুঝি না। যখন মানুষ এ পোশাকগুলো বড় বড় শোরুম থেকে কিনে ব্যবহার করেন, তখনই আমরা বুঝতে পারি এগুলো আমাদের হাতে তৈরি।
শঙ্খনীলের পরিচালক রজনী খান রুম্পা বলেন, আমাদের এখানে গ্রামীণ নারীদের দিয়ে পাঞ্জাবি, শাড়ি, কামিজ ও ছোটদের বিভিন্ন ধরনের পোশাকে নকশির কাজ করা হয়ে থাকে। আমাদের এই পোশাকগুলো দেশাল ও মেঠোপথে পাঠানো হয়।
সদর উপজেলার কেওয়ারজানি গ্রামের রোকেয়া আক্তার জানান, নকশার আকার অনুয়ায়ী একেকটি পাঞ্জাবিতে ভরাট কাজ করে পাওয়া যায় তিন শ’ থেকে হাজার টাকা। একেকটি পাঞ্জাবি নকশা করতে তিন-চার দিন লাগে। এসব ছাড়াও তারা শাড়ি, থ্রিপিসও সেলাই করে থাকেন। বাড়ির গৃহস্থালি কাজ শেষ করে সংসারের বাড়তি আয়ের জন্য এ কাজটি করছেন তারা। একই গ্রামের কলেজছাত্রী নাছরিন আক্তার জানান, পড়াশোনার ফাঁকে তিনি এ কাজ করে থাকেন। আগে এ কাজে সবাই আসতে চাইতেন না। এখন দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাওয়ায় অনেক শিক্ষিত তরুণীও এ কাজ করছেন। প্রতি মাসে চার-পাঁচটি পাঞ্জাবির কারুকাজ করা সম্ভব হয়। এতে দু-তিন হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। এ টাকা ব্যয় করা হয় ব্যক্তিগত কাজে। ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী ইউনিয়নের মির্জাপুর রাজবংশীপাড়ার সন্ধ্যা রানী রাজবংশী জানান, তার স্বামী নেই। দুই সন্তান ও মা-বাবা নিয়ে তার সংসার। বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালনের পাশাপাশি তিনি পাঞ্জাবি সেলাইয়ের কাজ করেন। এটি করে তার সংসারে বাড়তি আয় হয়। বেওথা গ্রামের গৃহবধূ সবজান বিবি জানান, তিনি ১০-১২ বছর ধরে সংসারের কাজের ফাঁকে এ কাজটি করছেন। প্রতিদিন ৩-৪ ঘণ্টা কাজ করলে মাসে আয় হয় ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। ঈদের আগে চাপ থাকে। সেজন্য ঈদের দুই মাস আগে ৬-৭ ঘণ্টা কাজ করেন। তাতে আয়ও বেড়ে যায়। তবে বান্দুটিয়া গ্রামের জাহানারা বেগম বললেন, মজুরি আরেকটু বাড়ালে তাদের সুবিধা হতো। কেননা তাদের হাতের কাজের একটি পাঞ্জাবি দোকানে যে দামে বিক্রি হয় সে তুলনায় তাদের মজুরি অনেক কম দেয়া হয়। তার হিসাবে একটা পাঞ্জাবিতে সুই-সুতার কাজ করে তারা বড়জোর তিন- চার শ’ টাকা পান। অথচ একটি পাঞ্জাবি কমপক্ষে বিক্রি হয় দুই হাজার থেকে ১০ হাজার টাকায়।
কেউ কেউ ব্যক্তি উদ্যোগে আবার কয়েকজন মিলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় একত্র করে শুরু করেছেন এই হ্যান্ডিক্র্যাফটের ব্যবসা। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে চলছে এই নকশার কাজ। কোথাও টিনের সিট তুলে আবার কোথাও নিজঘরে বসেই চলছে সুই-সুতার এই নান্দনিক কাজ। অনেকেই সারা বছর এ কাজ না করলেও ঈদকে সামনে রেখে লেগে যান সুই-সুতা হাতে। স্কুল-কলেজের ছাত্রী, গৃহবধূসহ অনেকেই হয়ে যান মওসুমি কারিগর। সময়টি অনেকটা উৎসবে রূপ নেয় এ অঞ্চলে।
জননী উইভিং অ্যান্ড ক্র্যাফটসের মালিক রফিকুল ইসলাম পরান জানান, তিনি ১৫-১৬ বছর আগে এ ব্যবসার সাথে যুক্ত হন। এবারের ঈদ ঘিরে ব্যাপক পরিমাণে পাঞ্জাবি, ফতুয়া আর শাড়ি তৈরি করা হয়েছে। এসব পোশাকে হাতের কাজ করার জন্য তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন অন্তত আট হাজার নারী। এবারের ঈদে তিনি অন্তত ৫০ হাজার পিস পাঞ্জাবি-ফতুয়া আর শাড়ি সরবরাহ করেছেন ঢাকার বিভিন্ন নামীদামি শোরুমে।
ঘিওরের বানিয়াজুরী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কাশেম চতু জানান, গ্রামীণ এসব নারী নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছেন।
এসব নকশী শিল্পীদের হাতের কাজে অনেকের ঈদ হয়ে উঠে বর্ণিল। কিন্তু তাদের জীবনে ঈদে কী আসে? সে ঈদ তারা কিভাবে পালন করেন সে খোঁজ আমরা কখনো করি না। তবে সেসব নকশিশিল্পীদের জীবনটাও বর্ণিল হউক, সবার মতো সমান আনন্দে তারাও ঈদ উদযাপন করুক এটাই প্রত্যাশা সবার।


আরো সংবাদ



premium cement