১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

অবলম্বন : চারাগল্প

-

রংপুর থেকে বদলি হয়ে দিনাজপুর চিরিরবন্দরে এলাম। নতুন কর্মস্থলে এসে প্রথম দিনেই সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠল। অফিস শেষে কলিগরা বলল, চলো, চায়ের দোকানে একটু আড্ডা দিই।
বললাম, চলো।
অফিসের নিচে বেশ কয়েকটা চায়ের দোকান। বললাম, এখানে কোথাও বসি।
না, এখানে নয়। টিঅ্যান্ডটি মোড়ে চলো। বলল এক কলিগ।
টিঅ্যান্ডটি মোড় তো দূরে। অত দূরে কেন?
ওখানকার চায়ের স্বাদই আলাদা। একবার খাও, দেখবে আজীবন মনে রাখবে।
কৌতূহলি মনে মুচকি হেসে বললাম, তাই নাকি?
জি।
চলো দেখি।
গিয়ে দেখি দোকানে এলাহি কাণ্ড!
টিন চালার ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। দোকানে কোনোরকম চারটা বেঞ্চ বসানো হয়েছে। বেঞ্চ চারটায় যত লোক বসেছে, তার দিগুণ লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। তারও দিগুণ লোক চায়ের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি অবাক। একটা চায়ের দোকানে এত ভিড় হয় কিভাবে? আমি জানার জন্য বললাম, এই চায়ের দোকানে কি শুধু বিকেলেই এরকম ভিড় হয়?
আমার কথা শুনতে পেলেন এক বৃদ্ধা। তিনিও কাস্টমার। চায়ের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। দূরে দাঁড়িয়ে তিনি কৌতূহলি মনে আমার গল্প শুনছিলেন। আমার প্রশ্ন শুনে তিনি আমার কাছে এগিয়ে এলেন। বললেন, না বাবা, এই দোকানে এরকম ভিড় সারাক্ষণই লেগে থাকে। সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত।
বলেন কী!
জি।
তাহলে তো দোকানদারের দৈনিক অনেক আয়।
হয় বৈকি। একটু থেমে বৃদ্ধা আবার বললেন, জানো বাবা, অথচ এই ছেলেটাকে (দোকানদারকে) নিয়ে বাবা-মায়ের চিন্তার অন্ত ছিল না। ছেলেটা পৃথিবীতে খাবে কী করে? কিন্তু আল্লাহর কী লীলাখেলা, এই ছেলেটাই এখন সংসারের একমাত্র অবলম্বন! আয়ের উৎস! এখন তার আয় দিয়েই পুরো সংসার চলে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তাকে নিয়ে বাবা-মা এত চিন্তিত ছিলেন কেন?
কারণ ছেলেটা অটিস্টিক। জন্মগত প্রতিবন্ধী। কথা বলতে পারে না। কানেও শুনতে পারে না। ইশারায় দোকানদারি করে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তাই নাকি?
তারপর লক্ষ করলাম ছেলেটার দিকে। ছেলেটা হেংলা পাতলা, লিকলিকে লম্বা। গভীর মনোযোগ চায়ের কাপে। সারাক্ষণ টুংটাং করে চা তৈরি করছে, আর দৌড়ে দৌড়ে কাস্টমারদের হাতে হাতে চা পৌঁছে দিচ্ছে। ভোর অবধি গভীর রাত পর্যন্ত এত যে পরিশ্রম করছে, তবুও তার শরীরে বা মুখে কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই। সবসময় ঠোঁটের কোণায় ঝুলে আছে একরাশ হাসির ঝিলিক। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এই ছেলেটা বাকপ্রতিবন্ধী। শুধু কাস্টমার টাকা দেয়ার সময় ডান হাত উঁচিয়ে অ্যা অ্যা করে।
বৃদ্ধা আরো বললেন, ছেলেটার দাদী ছিলেন খুবই পরহেজগার। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন। নামাজ পড়ে তার জন্য আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে দোয়া করতেন। বলতেন, আল্লাহ, তুমি এই বাকপ্রতিবন্ধী ছেলেটাকে কারো মুখাপেক্ষী করে রেখো না, তাকে নিজের একটা আয়ের পথ দেখিয়ে দাও। তাকে স্বাবলম্বী করে দাও। যেন তাকে কারো করুণার পাত্র হয়ে থাকতে না হয়। সবাই বলে দাদীর দোয়া আছে ছেলেটার সাথে।
গল্প করতে করতে আমাদের হাতে চা এসে গেল।
চায়ে চুমুক দিয়েই আমি অবাক। এত সুস্বাদু চা! এত সুস্বাদু চা কোনো দিন খাইনি। চা মুখে চুমুক দিতেই মনের অজান্তেই বেরিয়ে এলোÑ আল্লাহু আকবার!
চা খেতে খেতে চিন্তা করলাম, আল্লাহর কী মহিমা, কী লীলাখেলা! যাকে একদিন ভাবা হতো সংসারের বোঝা, আজ সেই হলো সংসারের একমাত্র অবলম্বন!
সেতাবগঞ্জ, দিনাজপুর।

 


আরো সংবাদ



premium cement