২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

হারিয়ে যাওয়া অভিশপ্ত পম্পেই শহর

-

ধ্বংস হয়ে যাওয়া পম্পেই নগরীর নামটি অনেকেরই অজানা! এটি এমন একটি নগরী, যেটি ধ্বংস হওয়ার সময় সেখানকার মানুষ চোখের পলক ফেলার সময়টুকু পায়নি। মুহূর্তেই মানুষগুলো ভস্মে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
ইতালির কাম্পানিয়া অঞ্চলের নেপলসের (ন্যাপোলি) কাছে যে আগ্নেয়গিরি রয়েছে, তার পাদদেশে ‘পম্পেই’ নামক ছোট্ট এ নগরীটি অবস্থিত। পাশেই রয়েছে নেপল উপসাগর। হাজার বছরের পুরনো একটি শহর এটি। খ্রিষ্টপূর্ব ৬-৭ শতাব্দীর দিকে ইতালির তৎকালীন রাজা ওসকানের দ্বারা এই শহরের গোড়াপত্তন হয়। এরপর ইউরোপের বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধের মাধ্যমে খ্রিষ্টপূর্ব ৮০ শতাব্দীর দিকে এই শহরটি রোমান সাম্রাজ্যের দ্বারা অধিকৃত হয় এবং সেখানে গড়ে ওঠে রোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম বাণিজ্য বন্দর। সেই থেকে রোমানরা সেখানে বসবাস শুরু করে।
অভাব নামক শব্দটি হয়তো তাদের কাছে ছিল একদমই অপরিচিত। প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যের এক অপার লীলাভূমি ছিল এ নগরটি। চার পাশে পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্যের হাতছানি। সে সময়কার পৃথিবীর সব থেকে সুখি নগরী ছিল এটি। কিন্তু এই নগরীর মানুষগুলো ছিল অত্যন্ত বর্বর, অসভ্য ও নির্মম। যৌনতা আর সমকামিতা ছিল তাদের পেশা। তারা যে আগ্নেয়গিরির পাদদেশে বসবাস করত, সেই আগ্নেয়গিরির আগুন ও ছাই এক মুহূর্তে ধ্বংস করে দেয় নগরীটিকে। সেখানকার মানুষ, পশুপাখিসহ সব জীবন্ত প্রাণের স্পন্দন চোখের পলকে ভস্মীভূত হয়ে যায়। অনেকে মনে করেন, তাদের এসব পাপের কারণেই তারা ধ্বংস হয়েছে।
সে সময় বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ পম্পেই শহরে আসত বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে। এটি ব্যবহার হতো বাণিজ্যিক বন্দর হিসেবে। শহরটির এক পাশে রয়েছে সমুদ্র, অপর দিকে সবুজ ভেসুভিয়াস পাহাড় ও বিশাল আকাশ। নগরীটি দু’ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি নিচু স্থান; যার নাম পম্পেই এবং অপরটি উঁচু স্থান; যার নাম হার্কুলেনিয়াম। তৎকালীন সময়ের রোমের বিশিষ্ট নাগরিকদের জন্য একটি সমৃদ্ধ আশ্রয়স্থল ছিল এ নগরীটি। মার্জিত ঘর এবং বিস্তৃত পাকা রাস্তা, অবাধ যৌনতা, পতিতালয় এসব কোনো কিছুর অভাব ছিল না এ নগরীতে। প্রাচীন গ্রিক, রোমসহ বিভিন্ন দেশের নাবিকদের অবাধ চলাচল ছিল এই নগরীতে। বাণিজ্যিক ট্যুরিস্টদের জন্য সেখানে গড়ে উঠেছিল অত্যাধুনিক দৃষ্টিনন্দন অট্টালিকা প্রাসাদ, বাজার ইত্যাদি। শহরটি ধীরে ধীরে প্রাচীনকালের আধুনিক সভ্যতার সব ধরনের চিত্তরঞ্জনের জন্য প্রাণবন্ত একটি শহরে পরিণত হয়ে ওঠে। তৎকালীন অভিজাত মানুষগুলোর আমোদপ্রমোদের কেন্দ্রস্থল ছিল এই নগরী। রোমের সব সম্পদশালী মানুষের অবসর কাটানোর শহর ছিল এই পম্পেই। কিন্তু প্রকৃতির এত সম্পদ পাওয়ার পরও ধীরে ধীরে প্রকৃতির নিদর্শনকে অস্বীকার করে পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে পম্পেইবাসী। এরা যৌনতায় এতই অন্ধ ছিল যে, বাড়ির গৃহকর্তা নিজের ছেলেমেয়েদের দিয়ে অতিথির যৌন বিনোদনের ব্যবস্থা করতে দ্বিধা করত না।
দিনকে দিন খ্রিষ্টান ধর্ম থেকে বিচ্যুত হতে থাকে তারা। সব ধর্মযাজক নগরী ছেড়ে চলে যায়। ধর্মীয় মানসিকতায় সামাজিক বা ধর্মীয় কনফ্রন্টেশন বা ব্যাকল্যাশের ভয়ে ইউরোপের কনজারভেটিভ ধর্মীয় সম্প্রদায় সাধারণত পম্পেই শহর পরিভ্রমণে বিরত থাকত।
খ্রিষ্টাব্দ ৭৯ সালের ২৪ আগস্ট। দুপুরবেলা ইতালির পম্পেই শহরের অধিবাসীরা কেউ বিশ্রামে ব্যস্ত ছিল, আবার কেউ আনন্দ-উদ্দীপনায় নিজেদের মত্ত রেখেছিল। ঠিক সেই সময় হঠাৎ করে শহরের পাশে অবস্থিত ভেসুভিয়াস পর্বতে কোনো প্রকার পূর্বসঙ্কেত ছাড়াই এক বিরাট ধরনের ক্যাটাস্ট্রোফিক অগ্ন্যুৎপাত ঘটে। সাধারণত কোনো অঞ্চলে আগ্ন্যুৎপাত হওয়ার কিছুক্ষণ আগে ওই অঞ্চলের পশুপাখির আচরণের মধ্যে এক ধরনের পূর্বসঙ্কেত লক্ষ করা যায়। পম্পেই শহরের ক্ষেত্রে তার কিছুই পাওয়া যায়নি বলে ঐতিহাসিকরা বর্ণনা করেছেন। ফলে পম্পেই শহরসহ শহরের ২০ হাজার অধিবাসী দিনে দুপুরে মাত্র অল্প কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ২০ ফুট আগ্নেয় লাভা আর ছাইভস্মের নিচে বিলীন হয়ে যায়। শহরের সব মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদরাজির তাৎক্ষণিক জীবন্ত কবর রচিত হয়। তারপর থেকে প্রকৃতির অভিশপ্ত এবং পাপিষ্ঠ শহর হিসেবে এই শহর প্রায় ১৭০০ বছর ধরে আধুনিক মানবসভ্যতার অগোচরে থেকে যায়। কেউ কখনো সেখানে ভুল করেও প্রবেশ করেনি।
কিছু অ্যামেচার আর্কিওলজিস্ট খ্রিষ্টাব্দ ১৭৪৯ সালে সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন ধ্বংস হয়ে যাওয়া পম্পেই। তারপর থেকে সেখানে উৎসাহী মানুষের আনাগোনা বাড়তে শুরু করে। ইতোমধ্যে প্রায় দুই হাজার বছর সময়ে শহরটি কয়েক হাজার ফুট মাটির নিচে বিলীন হয়ে গেছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement