২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

আমাদের নীল বাড়ি

-

আমার মাধ্যমিক পাসের পর আব্বা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে ভালো কলেজে ভর্তি করাবেন। সব ভালো কলেজ জেলা শহরে হওয়ার কারণে আব্বা ঠিক করলেন আমরা পুরো পরিবার গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যাবো। সেখানে ভাড়া বাসায় আব্বা সংসার সাজাবেন। কিন্তু আপত্তি তুললেন আম্মা। তিনি গ্রামের বাড়ির পোষা হাঁস-মুরগি, সবজির বাগান ফেলে শহরে যাবেন না। আব্বা শুরু থেকেই আম্মার এই যুক্তি আমলে নেননি। মেধাবী সন্তান এই আমাকে সুশিক্ষার জন্য ভালো কলেজের কোনো বিকল্প নেই। তাই শহরমুখী হওয়াটা জরুরি। অবশেষে আম্মা রাজি হলেন জেলা শহরে যেতে।
এক ঝড়ের সকালে আমরা গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসি। আব্বা আগেই রহিম ভিলা নামক এক ছয়তলা বাড়ির তিনতলা ভাড়া নিলেন। পুরো ছয়তলা বাড়িটি গাঢ় নীল কালারের। এই নীল বাড়ি আম্মার খুব পছন্দ হলো। ফলে গ্রাম থেকে ফেলে আসা পোষা হাঁস-মুরগি আর সবজি বাগানের দুঃখ অনায়াসে ভুলে গেলেন।
সেই নীল বাড়ির তিনতলায় সংসার সাজাতে আম্মা বেশ দক্ষ হয়ে উঠলেন। পুরো বাড়ির ভেতর-বাইরের দেয়ালের রঙ নীল। সেই নীলের মধ্যে আম্মা কি যে আনন্দ পেলেন। নিচের গ্যারেজ, ওপরের ছাদ, আর ঝুল বারান্দায় আম্মার অবাধ বিচরণ পুরো দালানের সবার চোখে পড়ল। প্রায়ই আব্বাকে আম্মার বলতে শুনিÑ ‘এখানে এত সুন্দর একটি নীল বাড়ি আছে, আগে বলোনি কেন, আমি চলে আসতাম।’ স্ত্রীর কথায় আব্বা মুখ টিপে হাসতেন কেবল।
এই নীল বাড়ির মালিকের স্ত্রী আল্পনা করিম, যিনি একসময়ে টিভিতে সংবাদ পাঠ করতেন, সেই আল্পনা করিম প্রায়ই ভাড়াটিয়াদের বাসায় এসে হুমকি-ধমকি দিয়ে যানÑ ‘পানি অপচয় কম করবেন, দেয়ালের রঙ যেন নষ্ট না হয়, জানালার গ্রিলে এত ধুলা কেন, সকাল-বিকেল ফ্লোর মুছতে হবে, দরজা আস্তে লাগাবেন, অহেতুক কলবেল চাপবেন না, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-নামতে শব্দ করা যাবে না’Ñ এই জাতীয় সংলাপ শোনাতে আল্পনা করিম বেশ কঠিন হয়ে ওঠেন। সে কারণে বেশির ভাগ ভাড়াটিয়া আল্পনা করিমকে একটু বাঁকা চোখেই দেখেন।
২. ক্লাস শেষে আজ বাসায় এসে দেখি আম্মা মন খারাপ করে বসে আছেন। আল্পনা করিম নাকি দুপুরে এসে আম্মাকে বকাবকি করেছেন। আম্মার অপরাধÑ তিনি টিভির ভলিউম বাড়িয়ে শিল্পী কনকচাঁপার একক গানের অনুষ্ঠান দেখেছেন। এই নীল বাড়িতে নাকি টিভির সাউন্ডও বেশি বাড়ানো যাবে না, আল্পনা করিম হুঙ্কারে জানিয়ে দিয়ে গেলেন। দ্বিতীয়বার যদি এমন ঘটনা ঘটে, তা হলে আমাদের এই নীল বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হবে। আম্মা এসব আমাকে বলেছেন আর আম্মার চোখে এসেছে জল।
আমি দক্ষিণের বারান্দায় এলাম। পড়ন্ত বিকেলের সোনা রোদ এসে বারান্দায় পড়েছে। দূরের আকাশে উড়ে যাচ্ছে একঝাঁক হলদে পাখি। আমি এখনো ছাত্র। পড়ালেখা শেষ হলে একটা চাকরি পেলে আমার যখন মাস শেষে বেতন আসবে, আমি সে বেতনের পয়সা জমিয়ে আম্মার জন্য একটি নীল বাড়ি বানাবে। এই নীল বাড়ি থেকে আমাদের সেই নীল বাড়ি দশগুণ সুন্দর হবে। আম্মা তার প্রিয় খয়েরি শাড়ি পরে নীল বাড়ির আনাচে কানাচে পায়চারি করবেন। কেউ বারবার কলবেল চাপলে বিরক্ত হবেন না। মাথার ওপর ভনভন করে ফ্যান ঘুরবে। সেই ফ্যানের তলে ইজি চেয়ারে বসে চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা পরে আম্মা শিল্পী কনকচাঁপার গানের অনুষ্ঠান দেখবেন ভলিউম বাড়িয়ে। তাকে কেউ কিচ্ছু বলবে না। অথবা বিকেলে নীল বাড়ির বারান্দায় এসে আম্মা খবরের কাগজে মগ্ন থাকবেন আর নিলা ও মিতা নামের কাজের মেয়ে দু’টি আম্মার জন্য লাল চা আর দুই পিস টোস্ট বিস্কুট নিয়ে আসবে। আম্মা খবরের কাগজ রেখে লাল চায়ে টোস্ট বিস্কুট চুবিয়ে খাবেন। এক ফাঁকে আব্বা এসে বলবেন, ‘খুব সুন্দর, তাই না শেলী?’ আম্মা আশ্চর্য হয়ে বলবেন, ‘কি খুব সুন্দর?’ আব্বা তখন হেসে বলবেন, ‘আমাদের নীল বাড়ি।’ আম্মা বিষণœ গলায় বলবেন, ‘এই নীল বাড়ি আমার স্বপ্ন ছিল। আমাদের ছেলে সে স্বপ্ন পূর্ণ করেছে।’ আর আমি দূর থেকে আম্মা-আব্বার আলাপন শোনে আনন্দে কেঁদে ফেলব। আম্মা জানতে চাইবেন কান্নার কারণ। আমি কান্না লুকোতে চাইব, কিন্তু পারব না। কিছু কিছু কান্না কখনো লুকানো যায় না।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী

 


আরো সংবাদ



premium cement