২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সারা বিকেলের কান্না

-

ছয় ভাইবোনের মধ্যে কনিষ্ঠ আমি। তখনো সাত পেরোয়নি। মায়ের সাথে সেবার নানাবাড়ি গেলাম। আমাদের সাথে ছিল আমার ইমেডিয়েট বড় বোন আট বছর বয়সী ফাতেমা। মায়ের কথা কাটাকাটি হলো বড় মামার সাথে। ছোট্ট সেই বয়সে কী অত কিছু বুঝতাম? মা কাঁদলেন অঝোরে। আমি অদূরে দাঁড়িয়ে শুধু মনমরা হয়ে তাকালাম। শাড়ির আঁচলে চোখের পানি মুছছিলেন। হঠাৎই মনটাকে শক্ত করে ফাতেমা বুবুকে সাথে করে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন বাড়িতে। বাড়ির রাস্তা কিভাবে এসেছি আজ তা অধরা। ছয় কিলোমিটার রাস্তার দূরত্ব। পড়ন্ত বিকেলে পৌঁছেছি বাড়িতে। বুবু যে কই গেল সে খবর নেই। আমি বাড়ির উঠোনে পাতা মাচানটাতেই বসেছিলাম। মনের মধ্যে এক কালবোশেখি ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। যেমনি মুয়াজ্জিন মাগরিবের আজান দিয়েছে অমনি আমি দৌড় শুরু করেছি নানাবাড়ি পানে।
রাস্তায় উঠতেই দেখি আবছা আঁধার চার ধারে। উত্তরমুখী ম্যারাথন দৌড়। কচি পা দু’খানা চলছিল না। তদুপরি কোত্থেকে যেন অজানা এক শক্তি ভর করল পায়ে। সামনে দেখছি টিমটিম আলো জ্বালিয়ে একটি ভ্যান যাচ্ছে। আমি অনুগামী হলাম ভ্যানটির। ভ্যানের যাত্রীরা কী বিষয়ে গল্পে মশগুল ছিল যে অদূরে তাদের অনুগামী এক শিশুর দৌড়ানো বুঝতেই পারেনি। ডাকালিগঞ্জ বাজার গেলাম এভাবে। সেখানে ভ্যানটা থেমে যায় দক্ষিণ মাথায়। আমি বাজারের উত্তর মাথায় গেলাম। দেখি একটি ভ্যান মিটিমিটি হারিকেনের আলোর রেখায় আনছারহাটগামী। অনুগামী হওয়াই ছিল শিশুসুলভ চৌকশতা। দুই কিলো দৌড়িয়েছি। আনছারহাট পৌঁছার পর দক্ষিণমুখী কোনো মিটিমিটি আলোর ভ্যান পাই না আর।
পিছনে ফিরে আসা ঘণ্টাখানেক সময়ের গা ছমছম আঁধারের অভিযান। আনছারহাট থেকে নানাবাড়ি যেতে আর কিলো দেড়েক পথ। তবে এই পথে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর একটি কবরস্থান আছে। আর সেই কবরস্থানটির পূর্ব দিক ও উত্তর দিক ঘিরে রাস্তা। দৌড়ে নাজেহাল। গলা শুকিয়ে কাঠ। বারবার শুষ্ক মুখ ও গলনালীতে ঢোক গিলে ভেজানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছিলাম। বাঁকানো সে পথে শিশুমনের সাহস নিয়ে দৌড় শুরু করি। রাস্তার দু’পাশে মাঝে মাঝে বাঁশের ঝাড়। সেই ঝোড়ের কাছে আসতেই শিউরে উঠি। দিনের বেলায় যেখানে শেয়াল কবরগুলো থেকে হাড়গোড় বের করে আনে। কবরের ভেতরের সুড়ঙ্গ দেখা যায়। সেখানে শেয়ালগুলো হাঁক ছেড়েছে। অভয়ারণ্য পেয়ে খুশিতে ছোটাছুটি করছে। বাঁশবাগানের ভয় এখানে মামুলি। এই বুঝি শেয়াল এসে পায়ে কামড়ে ধরে টেনে-হেঁচড়ে কবরের সুড়ঙ্গ দিয়ে ভেতরে নিয়ে আহার করবে আমায় দিয়ে। এই বুঝি কোনো মৃতের আত্মা আমার ওপর হামলিয়ে পড়বে। চোখ আমার ছুটে যাওয়ার হাল। ভয়ের জোরে কলিজায় সেই জোরে উথাল-পাতাল আছড়ে পড়া ঢেউ। ফেটে যায় বুঝি এখনি।
মা! মা! বলে ডাক দিয়েছি নানাবাড়ির উঠোনে। মা দেখি উঠোনে পাতানো মাচায় বসে। আমাকে পেয়ে কী যে পেল! কী যে কাক্সিক্ষত ছিলাম! মরাকান্না কেঁদে উঠল। এমনভাবে আঁকড়ে ধরল যেন কোনো হিংস্র প্রাণী ছোবল দিয়ে নিয়ে যাবে আমায়। ‘আমি এখনো বাড়ির মধ্যে ঢুকিনি রে বাবা! সারা বিকেল ওই গাছতলায় কেঁদেছি।’ আশপাশের বাড়ির মানুষজন আমায় দেখে থ!

 


আরো সংবাদ



premium cement