২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাবার পদরেখা

-

বাবার বয়োবৃদ্ধ মুখাবয়বে আজকাল কেমন হতাশার ছাপ ঝুলে থাকে। সেই শৈশব থেকেই দেখে আসছি তীব্র সংগ্রাম, শত ঝড়ঝাপটে উপেক্ষা করে আমাদের তিন তিনটি ভাইকে কোলেপিঠে করে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। বাবার স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা, প্রত্যাশার জায়গাগুলো বোধহয় আমরা পূর্ণ করতে ব্যর্থ। মেজো ভাইয়াকে নিয়ে বাবার তুমুল স্বপ্ন ছিল। পরিবারে একজন আলেম হওয়ার প্রত্যাশা বাবার মনে সবসময় লালিত হতো। কী এক আকস্মিক ঘটনায় বাবার এই স্বপ্ন নিঃসীম আকাশের মেঘেদের সাথে মিলিয়ে গেল, দুমড়ে মুচড়ে গেল সব। সে দিন বোধহয় বাবা জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেলেন।
আমার বাবা আমার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একজন। বাবা হাল ছাড়লেন না, হাল ছাড়ার মতো মানুষ আমার বাবা নন। কিছু দিন মন খারাপ করে, বাবা-মা দু’জন সেই ছোট্ট আমাকে নিয়ে নতুন করে স্বপ্নের বীজ বপন করতে লাগলেন মনের মণিকোঠায়। এটাই বাবার শেষ প্রচেষ্টা, শেষ সংগ্রাম, হয়তো শেষ স্বপ্নও।
২। সংসারের হাল ধরতে গিয়ে ন্যুব্জ হয়ে যাওয়া বাবা শত ঝড়ঝাপটা উপেক্ষা করে আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রত্যাশাগুলো কিভাবে যেন পূরণ করতেন। দশজন ছেলেমেয়ে লালনপালনে বিধ্বস্ত এক বৃদ্ধের ঘরেরই তো সন্তান আমার বাবা। যার শৈশব-কৈশোর পেরিয়েছে অনেক না পাওয়া বেদনাবোধ নিয়ে; সেই একই বোঝা যেন তিনি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন। হয়তো এই প্রজন্মের মানুষ বলে তেমন অভাব-অনটন আমাদের ছুঁতে পারে না। কিন্তু আমার বাবারা এবং তার বাবারা একেকটি দিন একেকটি রাত পার করেছেন অনেকটা শতাব্দীর অচেনা অজানা না খাওয়া মানুষদের মতো। নুন আনতে পানতা ফুরোয় এই বচন বোধহয় ওই সময়কার।
হয়তো অনেকেই ভাবছেন, বর্তমান সময়ে কত না খাওয়া মানুষ রয়েছে, তাদের নিয়ে কেন বলা হচ্ছে না! আমি শুধু আমার বাবাকে নিয়ে কিছু লিখতে চাই, একজন সংগ্রামী, পরিশ্রমী, নিম্নমধ্যবিত্ত ঘর থেকে উঠে আসা এক সন্তান, যার বয়স এখন পঞ্চাশোর্ধ; তিনি আমার বাবা। তাকে নিয়ে আমার হৃদয়ের প্রেম, ভালোবাসা গভীরতার বহিঃপ্রকাশ না করতে পারলে হয়তো আমার এই সাহিত্যজ্ঞান অর্থহীন বলে বিবেচিত হতে পারে।
পৃথিবীর প্রতিটি বাবাই নিরপরাধ। যারা অপরাধী তারা প্রকৃত বাবা নন। বাবারা নিষ্পাপ, নিরপরাধ। আমার এমনটাই মনে হয়Ñ কারণ আমার বাবা একজন ন্যায়-নিষ্ঠাবান ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত নীতিবাদী ব্যক্তি। আমার বুঝ হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছি নির্বিশেষে তিনি একজন আদর্শ বাবা। একজন বাবা তার চারিত্রিক গুণাবলি দ্বারা সন্তানকে গড়ে তোলেন, তুলতে পারেন। আবার কারো সন্তান ঠিক বাবার উল্টো চারিত্রিক গুণাবলি নিয়ে বেড়ে ওঠে।
জীবনের কতগুলো বছর হেলায়-ফেলায় কেটে যায় আমাদের। শৈশব-কৈশোরে অতঃপর তরুণ হয়ে যাওয়ার পর থেকে নানাবিধ ব্যস্ততার বেড়াজালে আটকে যাওয়ার ফলে ক্রমাগত বাবাদের স্নেহ, অসীম ভালোবাসার মুহূর্তগুলো আমরা ভুলে যাই। শৈশবে কতবার যে বাবা আমার গালে, কপালে চুমু খেয়েছেন; সে হিসেবে আমরা সন্তানরা বাবাদের দীর্ঘ বছর ধরে ক্লান্তির ভাঁজ পড়া কপালে কখনো কি একটি চুমু খেয়েছি! নাহ্! হঠাৎ হঠাৎ উছলে ওঠা এসব প্রেম-ভালোবাসার স্থায়িত্ব প্রয়োজন। আমি বলছি অথবা বলব প্রকাশ্যেই গোপনে নয়।
বাবা! ও বাবা! শুনছো তুমি! তোমার ঋণ তো কখনো শোধ করা সম্ভব নয়। তাই এভাবে ভালোবাসার সামান্য প্রতিকার নিরাময়ের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা করছি।
শোনো বাবা! আমি তোমাকে ভালোবাসি তো! জানো কতটুকু, ওই দেখো নিঃসীম আকাশে জ্বলজ্বল করে ওঠা নক্ষত্র অথবা চাঁদ তার চেয়েও নয়তো এই বিশাল আকাশের চেয়েও অধিক থেকে অধিকতর।
শ্যামলাপুর, সাভার, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement