২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বৈশাখী মেলা

-

পয়লা বৈশাখ আর বৈশাখী মেলা যেন মানুষের মাঝে প্রাণের স্পন্দন হয়ে আছে। বাঙালির কৃষ্টিকালচার আর ঐতিহ্য নিয়ে বর্ণিল সাজে মঙ্গল শোভাযাত্রা, পান্তা-ইলিশের আয়োজন ও গ্রামে গ্রামে বৈশাখী মেলা আয়োজনের মাধ্যমে এখানে চলে বর্ষবরণ। আবহমান বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য এই মেলা। মেলায় নানা স্বাদের মুড়ি-মুড়কি আর পিঠাপুলি তো রয়েছেই। সেই আদিকাল থেকে জনপ্রিয় যাত্রা, সামাজিক নাটক, বিনোদনমূলক সাংস্কৃৃতিক অনুষ্ঠানসহ পুতুলনাচের আসরও এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ। আর নাগরদোলায় হাওয়ায় ভেসে নববর্ষের নতুন মুহূর্তগুলোকে উপভোগ করার অনুভূতি যেন একেবারেই ভিন্ন। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাবার পরিবেশন আর নতুন পোশাকাদিতে চার দিকে বয়ে যায় নব উৎসবের ঢেউ।
‘মেলায় যাইরে...’ পয়লা বৈশাখ এলেই আমাদের কানে সবচেয়ে বেশি ভেসে আসে এই সুরটি। আজ থেকে ২৯ বছর আগে ফিডব্যাকের ‘মেলা’ অ্যালবামে গানটি প্রকাশিত হয়। তার পর জনপ্রিয়তার মাত্রা কতটা পেয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আসছে ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখÑ বাঙালির দ্বারে আরো একটি নতুন বছর। পয়লা বৈশাখকে বরণ করতে আনন্দে মেতে ওঠে বাঙালি জাতি। তারই ধারাবাহিকতায় সারা দেশের গ্রামীণ জনপদের লোকজনের মাঝে বইছে প্রাণের ছোঁয়া। বাঙালির প্রাণের উৎসব নববর্ষ বরণ ও উদযাপনে অবিচ্ছেদ্য অংশ মেলা।
চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে চৈত্র মাসের শেষ দিন জেলার বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয় বারণী পূজা মেলা। স্থানীয়ভাবে যা পরিচিত ‘বান্নি’ নামে। পূজাকেন্দ্রিক এ মেলাকে কেন্দ্র করে সুদীর্ঘকাল ধরে এ জনপদে আবর্তিত হচ্ছে বাংলার লোকায়ত জীবন, চিন্তা-চেতনা ও লোকায়ত সংস্কৃতির ধারা। গ্রামীণ এ মেলা সব ধর্মের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সার্বজনীন উৎসবের এক অনবদ্য উদাহরণ। বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে পরদিন পয়লা বৈশাখে এ মেলা পরিণত হয় বৈশাখী মেলায়।
অনেক জায়গায় কেবল পয়লা বৈশাখে বসে দিনব্যাপী এ মেলা। আবার কোনো কোনো জায়গায় বৈশাখ মাসের বিশেষ তারিখ ও বারে অনুষ্ঠিত হয় বৈশাখী মেলা। একসময় এসব মেলায় সার্কাস, পুতুলনাচ, যাত্রা দল আসত, বসত নাগরদোলা। নিরাপত্তাহীনতাসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতায় তাদের মেলায় আগমন বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া খোলা মাঠের বিশাল পরিসরে ছোটদের খেলনা, হাতে তৈরি বিভিন্ন মৃৎশিল্পের সামগ্রী এবং বিন্নি ধানের খই, মুড়ি, তিলুয়া, কদমা, বাতাসা, জিলাপি, মিষ্টিসহ হরেক রকম খাদ্যসামগ্রীর পসরা সাজিয়ে বসতেন ব্যবসায়ীরা। পাওয়া যেত কাঠ-বাঁশের তৈরি গৃহস্থালি জিনিসপত্র থেকে শুরু করে প্রসাধনসামগ্রী পর্যন্ত। কিন্তু কালের বিবর্তনে ঐতিহ্য হারাচ্ছে এসব গ্রামীণ মেলা।
এ ছাড়া রয়েছে হরেক রকমের কুটিরশিল্প আর হস্তশিল্পের বাহারি প্রদর্শনী। দেখা মেলে বাংলার ঐতিহ্য মাটির তৈরি বিভিন্ন পণ্যের। এ মেলা বাঙালির আনন্দঘন লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক, আবহমান বাংলা ও বাংলাদেশের প্রতিমূর্তি। সময়ের প্রবাহে মোগল প্রবর্তিত বাংলা নববর্ষের উদযাপন-আয়োজনে এসেছে পরিবর্তন। পরিবর্তন এসেছে চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈশাখী মেলায়ও।
চৈত্রসংক্রান্তি থেকে পুরো বৈশাখ মাসে বিভিন্ন স্থানে বসে বৈশাখী মেলা। মানিকগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে অর্ধশত মেলার আসর জমবে নববর্ষে। আর এ মেলাকে সামনে রেখেই জেলার প্রায় ৩০ হাজার তাঁত, হস্ত ও মৃৎশিল্পী, মিষ্টির কারিগর আর ভ্রাম্যমাণ পসরা বিক্রেতারা পার করছেন ব্যস্ত সময়।
বৈশাখী মেলার অন্যতম আকর্ষণ মাটির তৈরি খেলনাসহ বিভিন্ন তৈজসপত্র। বৈশাখী মেলায় মাটির খেলনা ও তৈজসপত্র বিক্রির প্রস্তুতি নিতে চৈত্র মাসের শুরু থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ঘিওর উপজেলাসহ জেলার চার সহস্রাধিক মৃৎশিল্পী। বাড়ির পুরুষদের কাজে সহযোগিতা করতে ঘরে বসে নেই ওই সব পল্লীর রমণী। বৈশাখী মেলার খেলনা তৈরির মাধ্যমে হাতেখড়ি পালপাড়ার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিশুদেরও।
কর্মমুখর কুমারপাড়ায় কোথাও হচ্ছে মাটি থেকে কাদা তৈরির কাজ, কোথাও হচ্ছে নানা আকারের পাত্র তৈরি। পণ্য তৈরি শেষে শুকানো হচ্ছে তা। সবশেষে দেয়া হচ্ছে রঙতুলির আঁচড়। এখানকার পণ্য নিয়ে কুমাররা বেরিয়ে পড়বেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বৈশাখী মেলায়। সেসব মেলায় নিজেদের বানানো পণ্যের পসরা সাজিয়ে বিক্রি করবেন তারা। ঘিওরের পালপাড়ার মৃৎশিল্পী, তরণী পাল, প্রবীণ সুখেন পাল ও গৃহবধূ শিল্পী রানী পাল জানান, তারা প্রত্যেকেই মেলার জন্য মাটি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলনা ও তৈজসপত্র তৈরি করছেন। চাহিদার কথা চিন্তা করে পুতুল, ব্যাংক, আম, কাঁঠাল, হরিণ, ঘোড়া, হাতি, মাছ, ময়ূর, সিংহসহ হরেকরকম শিশুখেলনা, ঘর গৃহস্থালির হাঁড়ি-পাতিল, ঢাকনা, ঝাঁজর, কলসসহ বিভিন্ন তৈজসপত্র, ঘর সাজানোর জন্য ফুলদানি, টবসহ নানা জিনিসপত্র তৈরি করছেন।
উপজেলার জাবরা পালপাড়া এলাকার প্রমীলা রানী পাল বলেন, আমাদের এ এলাকায় আগে আরো অনেক পরিবার ছিল, যারা এ শিল্পের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। কিন্তু এখন আর কেউ এ ব্যবসায় থাকতে চান না। সামনে পয়লা বৈশাখ। আর তাই আমাদের কাজের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। দিন-রাত এক করে কাজ করতে হচ্ছে। এ মেলা আমাদের আয়ের বড় একটি উৎস।
এ ছাড়াও সারা দেশেই রয়েছে মানিকগঞ্জের মিষ্টির কদর। হরেক স্বাদের মিষ্টি ছাড়া বৈশাখী মেলা কল্পনাও করতে পারে না মানিকগঞ্জের লোকজন। রসগোল্লা, জিলাপি, দধি, মাষকলাই আমিরতি, রসমালাই, সন্দেশ, কালোজাম, চমচম তৈরি করতে দুধ, চিনি, গুড়, মাষকলাইসহ অন্যান্য উপকরণ ক্রয় এবং মিষ্টি তৈরি করার কাজে দম ফেলার ফুসরত নেই ঘোষপাড়ার নারী-পুরুষদের। জেলায় এ পেশার সাথে জড়িত রয়েছে প্রায় ছয় হাজার লোক।
জেলার সাতটি উপজেলাতেই রয়েছে কমবেশি তাঁতশিল্প। বৈশাখী শাড়ি, লুঙ্গি, বাহারি রঙের গামছা তৈরির কাজে মানিকগঞ্জের তাঁতশিল্পীদের ঘুম নেই চোখে। এ ছাড়াও মানিকগঞ্জের সিল্ক, মসলিন, থানকাপড় ও কারুকাজসমৃদ্ধ শাড়ির কদর দেশজুড়ে। তাঁতমালিক আবদুল বাসেত মিয়া জানান, মালিক-শ্রমিক মিলে প্রায় ১০ হাজার লোক এ পেশার সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত।
তাঁতশ্রমিক আজমত মল্লিক জানান, দিন প্রতি ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা রোজগার করছেন একেকজন শ্রমিক। তবে পয়লা বৈশাখ ও ঈদ-পূজায় রোজগার বেড়ে যায়। কুটিরশিল্পীরা বাঁশ-বেতসামগ্রী, রঙিন হাতপাখা, মোড়া, টেবিলম্যাট, ওয়ালম্যাট, ট্রে, ফুলদানি, ছাইদানি, শিশুদের খেলনাসামগ্রীসহ ঘর গৃহস্থালির বিভিন্ন উপকরণ তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন জেলার দুই হাজারেরও বেশি পরিবার। তাদের চোখে স্বপ্ন এসব পণ্যসামগ্রী নিয়ে মেলায় অংশ নেবেন তারা।
ঘিওরের রাধাকান্তপুর মেলা কমিটির আহ্বায়ক মীর কায়সার হামিদ বলেন, নববর্ষ উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারো সাত দিনব্যাপী মেলার আয়োজন করা হয়েছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ মেলা হয়ে ওঠে গ্রামীণ ও শহরের মানুষের প্রাণের উৎসব।
মানিকগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি গোলাম ছারোয়ার ছানু বলেন, আগে কয়েকটি গ্রামের সীমান্তবর্তী স্থানে, অথবা নদীর ধারে, বটতলায় বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হতো। এসব মেলায় নামত হাজার হাজার মানুষের ঢল। মেলায় থাকত কাচের চুড়ি, রঙ-বেরঙের ফিতা, তাঁতের শাড়ি, নকশা করা হাতপাখা, কামার ও কুমারের দোকান, মুড়ি-মুড়কি-খই, সন্দেশ, বাতাসা, মিষ্টি, মাটির তৈরি খেলনা, পুতুল, ঘুড়ি, নাটাই, গুলতি, অলঙ্কার, তৈজসপত্র, বেলুন, বাঁশি, ফলমূল প্রভৃতি। আর বিনোদনের জন্য থাকত নাগরদোলা, বায়োস্কোপ, জারিসারি-ভাটিয়ালি গানের আসর, কবিগান, ষাঁড়ের লড়াই, লাঠিখেলা, পুতুলনাচ, নৌকাবাইচ, কুস্তি খেলা প্রভৃতি। তবে দিন দিন এসব সুখস্মৃতি ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা বারসিকের আঞ্চলিক কর্মকর্তা বিমল রায় জানান, দিন দিন শহুরে বৈশাখী মেলার প্রচলন ও জনপ্রিয়তা বাড়ছে। শহুরে মানুষের ব্যস্ততা ও ক্লান্তির ফাঁকে একটুখানি আনন্দ পাওয়ার সুযোগ এনে দেয় এই মেলা। শহুরে বৈশাখী মেলায় তাই খেলনা, চুড়ি, বাঁশি, বেলুনÑ সব পাওয়া গেলেও শাকসবজি পাওয়া যায় না। এই মেলা শুধুই আনন্দের স্থান, ক্লান্তি কাটিয়ে নিজেকে চাঙা করে তোলার স্থান। তবে শহুরে বৈশাখী মেলা মূল বৈশাখী মেলার চেয়ে অন্য রকম হলেও এটি শহুরে মানুষদের বাঙালির ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। মেলায় থাকে নাগরদোলা, পুতুলনাচ, সার্কাসসহ বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের উপস্থিতি। আর এই মেলার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।
নারী উন্নয়ন নেত্রী লক্ষ্মী চ্যাটার্জি জানান, একসময় মেলা ও এর আশপাশের পুরো এলাকা পরিণত হতো বছরের প্রধান উৎসবে। মেলাকে কেন্দ্র করে এলাকার পরিবারগুলো আগে থেকেই টাকা জমিয়ে রাখত মেলায় খরচ করবে বলে। দূরবর্তী আত্মীয়স্বজনকে মেলার বিশেষ দাওয়াত দেয়া হতো। ঘরে ঘরে রাত জেগে মহিলারা সুনিপুণ শব্দময় ছন্দে গায়েলে ধানের চিঁড়া ভানতেন। মেলার অতীত সে ঐতিহ্য আজ অনেকটাই হারিয়ে গেছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement