২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সোনারগাঁও জাদুঘর

-

প্রাচীন বাংলার প্রথম রাজধানী সোনারগাঁও। প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দর্শনীয় স্থান সোনারগাঁও। সোনারগাঁওয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো সোনারগাঁও জাদুঘর। জাদুঘরে প্রবেশের জন্য টিকিট সংগ্রহ করে প্রধান ফটক দিয়ে একটু সামনে এগোলেই চোখে পড়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুলিল্প জাদুঘর। জাদুঘরের ভবনটি পুরোটাই লাল রঙ করা। এ জাদুঘরটিতে সংরক্ষিত রয়েছে আমাদের দেশের হারিয়ে যাওয়া লোক ও কারুশিল্প। জাদুঘরের নিচতলায় বোর্ডে টানানো সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে জানা যায়, সোনারগাঁওয়ের প্রাচীন নাম ছিল সুবর্ণগ্রাম। বাংলার বারো ভূঁইয়ার অন্যতম ঈশা খাঁর রাজধানীও ছিল সোনারগাঁও। ঈশা খাঁর রাজধানী হিসেবেই সোনারগাঁও সবচেয়ে খ্যাতি লাভ করে। পরবর্তীকালে আবহমান বাংলার লোকসাংস্কৃতিক ধারাকে বিকশিত করার উদ্যোগে ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সোনারগাঁওয়ের ঐতিহাসিক পানাম নগরীর একটি পুরনো বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। পরে ১৯৮১ সালে ১৫০ বিঘা আয়তনের কমপ্লেক্সে খোলা আকাশের নিচে বাংলার প্রকৃতি ও পরিবেশে গ্রামীণ রূপকেন্দ্রিক বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের শৈল্পিক কর্মকাণ্ডের পরিচয় তুলে ধরতে শিল্পী জয়নুল আবেদিন এই জাদুঘর উন্মুক্ত পরিবেশে গড়ে তোলার প্রয়াস নেন এবং বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন কমপ্লেক্সটি প্রায় ১০০ বছর পুরনো সরদার বড়িতে স্থানান্তরিত হয়। এখানে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের অবহেলিত গ্রামবাংলার নিরক্ষর শিল্পীদের হস্তশিল্প, জনজীবনের নিত্যব্যবহার্য পণ্যসামগ্রী। এসব শিল্পসামগ্রীতে তৎকালীন প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পের রূপচিত্র প্রস্ফুটিত হয়। সরদার বাড়িতে মোট ১০টি গ্যালারি রয়েছে। গ্যালারিগুলোতে কাঠ খোদাই, কারুশিল্প, পটচিত্র ও মুখোশ, আদিবাসী জীবনভিত্তিক নিদর্শন, গ্রামীণ লোকজীবনের পরিবেশ, লোকজ বাদ্যযন্ত্র ও পোড়ামাটির নিদর্শন, তামা-কাঁসা-পিতলের নিদর্শন, লোহার তৈরি নিদর্শন, লোকজ অলঙ্কারসহ রয়েছে বহু কিছু। ভবনটির সামান্য পূর্বে রয়েছে লোকজ স্থাপত্যকলায় সমৃদ্ধ আধুনিক এক ইমারতে প্রতিষ্ঠিত জয়নুল আবেদিন স্মৃতি জাদুঘর। এ ভবনটিতে মাত্র দু’টি গ্যালারি। এ দু’টি গ্যালারির মধ্যে একটি গ্যালারি কাঠের তৈরি, যা প্রাচীন ও আধুনিককালের নিদর্শনসমৃদ্ধ। তা ছাড়া বাংলাদেশের প্রাকৃতিক, বৈশিষ্ট্য কাঠ এবং কাঠ থেকে বিভিন্ন কারুপণ্য তৈরি এবং সর্বশেষ বিক্রির সব প্রক্রিয়া অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে সুন্দর মডেল দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ দু’টি ভবনের বাইরে রয়েছে পাঠাগার, ডকুমেন্টেশন সেন্টার, সেমিনার হল, ক্যান্টিন, কারুমঞ্চ, গ্রামীণ উদ্যান ও বিভিন্ন রকম বৃক্ষ, মনোরম লেক, লেকের মাঝে ঘুরে বেড়ানোর জন্য নৌকা, মৎস্য শিকারের সুন্দর ব্যবস্থা ও পঙ্খীরাজ নৌকা ইত্যাদি। প্রাচীন সব জিনিসপত্র কিছুক্ষণের জন্য হলেও মনকে নিয়ে যায় দূর অতীতে। কল্পনায় ভেসে ওঠে সেই মানুষদের জীবন-জীবিকার নানা ঘটনাপ্রবাহ। ঐতিহাসিক পানাম নগরও সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত। পানাম যে এ দেশের প্রধান ব্যবসায়িক কেন্দ্র ছিল, সেটি অনুমান করা যায় রাজপ্রাসাদ দেখে। পানামের টিকে থাকা বাড়িগুলোর মধ্যে ৫২টি বাড়ি উল্লেখযোগ্য। পানাম সড়কের উত্তর পাশে ৩১টি আর দক্ষিণ পাশে ২১টি বাড়ি রয়েছে। বাড়িগুলোর বেশির ভাগই আয়তাকার, উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত, উচ্চতা একতলা থেকে তিনতলা। বাড়িগুলোর স্থাপত্যে ঔপনিবেশিকতা ছাড়াও মোগল, গ্রিক ও গান্ধারা স্থাপত্যশৈলীর সাথে স্থানীয় কারিগরদের শিল্পকুশলতার অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায়। প্রতিটি বাড়িই ব্যবহার উপযোগিতা, কারুকাজ, রঙের ব্যবহার ও নির্মাণকৌশলের দিক দিয়ে উদ্ভাবনী কুশলতায় ভরপুর। ইটের সাথে ব্যবহার করা হয়েছে ঢালাই-লোহার, ভেন্টিলেটর আর জানালার গ্রিল। মেঝেতে রয়েছে লাল, সাদা, কালো মোজাইকের কারুকাজ। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই খিলান ও ছাদের মধ্যবর্তী স্থানে নীল ও সাদা ছাপ রয়েছে। এ ছাড়া বাড়িগুলোতে নকশা ও কাস্ট আয়রনের কাজ নিখুঁত। কাস্ট আয়রনের এ কাজগুলো ইউরোপের কাজের সমতুল্য বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এর সাথে আছে সিরামিক টাইলসের রূপায়ণ। প্রতিটি বাড়িতেই অন্দরবাটি ও বহির্বাটিÑ এ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। বেশির ভাগ বাড়ির চার দিকের ঘেরাটোপের ভেতর আছে উন্মুক্ত উঠান।
পানাম নগরীর পরিকল্পনাও নিখুঁত। নগরীর পানি সরবাহের জন্য দুই পাশে দু’টি খাল ও পাঁচটি পুকুর আছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই আছে কুয়া বা কূপ। নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত রাখতে করা হয়েছে খালের দিকে ঢালু। প্রতিটি বাড়ি পরস্পর থেকে দূরত্বে রয়েছে। নগরীর যাতায়াতের জন্য জন্য রয়েছে এর একমাত্র রাস্তা, যা এই নগরীর মাঝখান দিয়ে চলে গেছে।


আরো সংবাদ



premium cement