১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গল্পটা একাত্তরের

চারাগল্প
-


মায়মুনার মনটা ভালো নেই।
বাবা পাকিস্তানি মিলিটারিদের হয়ে কাজ করেছেন। মিলিটারিদের সহযোগিতা করছেন। সবাই যখন দেশের জন্য যুদ্ধে করছেন, বাবা তখন পাকিস্তানিদের হয়ে কাজ করছেন! এ কথা ভাবতেই গা ঘিনঘিন করে উঠে মায়মুনার। চোখ ফেটে পানি আসে তার।
রাতে বাবাকে খেতে দিয়ে বলল, বাবা, সবাই তো দেশের জন্য যুদ্ধ করছে, তুমি কেন দেশের জন্য যুদ্ধ করতে যাচ্ছ না? কেন মিলিটারিদের দোসর হয়ে কাজ করছ? ওরা তো হায়েনা। তুমি কেন হায়েনারদের হয়ে কাজ করছ?
বাবা নুরু ফ্যালফ্যাল চোখে মেয়ের দিকে তাকান। অপরাধী গলায় বলেন, হায়েনা বলেই তো ওদের হয়ে কাজ করছি রে মা!
মায়মুনা বলল, মানে?
আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করলে মিলিটারিরা এসে হায়েনারা মতো তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। তোমাকে ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করবে। মেরে ফেলবে। তোমার জন্যই তো...।
বাবার কথা শেষ হয় না। ডুকরে কেঁদে উঠে মায়মুনা। আমি কেন সুন্দরী হয়েছি, বাবা!কেন? তুমি আমার মুখে বিষ ঢেলে দাও, আমাকে মেরে ফেল। তার পর মুক্তিযুদ্ধে যাও। দেশের জন্য যুদ্ধ করো। তোমাকে রাজাকারে দেখতে আমার একটুও ভালো লাগে না, বাবা!
ওভাবে বলো না রে মা, ওদের হয়ে কাজ করতে ঘৃণায় আমারও শরীর রি রি করে। কিন্তু কী করব বলো ? তোমাকে হারালে যে আমি আর বাঁচতে পারব না। তোমার মাকে হারিয়ে তোমাকে আঁকড়ে ধরেই তো বেঁচে আছি আমি।
বাবা-মেয়ের গল্প শেষ হলো না। তার আগেই বুটের খটখট শব্দে কয়েকজন মিলিটারি চলে এলো বাড়িতে। নুরু বাড়িতে আছো?
জি স্যার।
কী করো?
ভাত খাচ্ছি।
আর ভাত খেতে হবে না। উঠ। চলো আমাদের সাথে।
কোথায় স্যার?
আলতাফ মাস্টারের বাড়ি।
কেন?
একটা মিলিটারি কটমট চোখে নুরুর দিকে তাকাল। নুরু।
জি স্যার।
তুমি তো একটা বতল। গাধা। তোমাকে খামাখা আমরা এজেন্ট নিয়োগ করেছি। তোমার গ্রামে কী হচ্ছে, তুমি তো কোনো খবরই আমাদের জানাচ্ছ না।
দিচ্ছি তো স্যার।
আলতাফ মাস্টারের যে একটা টিনএজ মেয়ে আছে। দেখতে খুব সুন্দরী। সে কথা কি তুমি আমাদের বলেছ ?
বুকটা ধক করে উঠে নুরুর। এ্যাঁ !
আর তোতলাতে হবে না। চলো আমাদের সাথে। আলতাফ মাস্টারের মেয়েকে চিনিয়ে দেবে। আমরা তাকে ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যাবো। সারারাত ফুর্তি করব।
আলতাফ স্যারের মেয়ে সখিনা মায়মুনার বান্ধবী। বান্ধবীকে মিলিটারিরা তুলে নিয়ে যাবে শুনেই কাঁদতে লাগল মায়মুনা।
গভীর রাত। ঘুমতে পারছে না ও। বান্ধবীর জন্য মন ছটফট করছে। উঠে বারান্দায় পায়চারি করছে সে। তখনই শুনতে পেল শব্দটা। গোঙানি শব্দ। রাস্তার ওপাশে ঝোঁপ থেকে ভেসে আসছে।
কে ওখানে? কে? বলল সে।
আ...মি... মু...ক্তি...আহ! ব্যথা। পা...নি...!
বুঝতে আর বাকি রইল না মায়মুনার। এক গ্লাস পানি নিয়ে দৌড়ে গেল সেখানে। দেখল একটা ছেলে ঝোঁপের ভেতর পড়ে আছে। কাঁধে এলএমজি বন্দুক। রক্তাক্ত পা। পায়ে গুলি লেগেছে। ব্যথায় কুঁকড়ে আছে। মুখ দিয়ে গোঁঙানির শব্দ বের হচ্ছে।
আপনি বীর মুক্তিযোদ্ধা? বলল মায়মুনা।
ছেলেটা বলল, জি। তার পর বলল, একটু পানি!
মায়মুনা তাড়াতাড়ি পানির মগটা মুখে ধরল।
ঢোক ঢোক করে পানি খেল সে।
এ কী! আপনার শরীর তো গরমে পুরে যাচ্ছে! গায়ে ভীষণ জ্বর! চলুন আমার সাথে। বলেই মায়মুনা তার একটা হাত নিজের কাঁধে তুলে নিল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাসায় নিয়ে এলো। আনছারুল গ্রামের হাতুরি ডাক্তার। তিনি মুক্তিযুদ্ধে না গেলেও মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেন। মায়মুনা তাকে ডেকে নিয়ে এলো। তিনি অনেক প্রচেষ্টার পর পা থেকে গুলি বের করলেন। জ্বর ও ব্যথার ওষুধ দিলেন। বললেন, এই ওষুধগুলো খাওয়াবে, আর মাথায় পট্টি দেবে, আশা করি তিনি খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন।
মায়মুনা ঝানু নার্সের মতো তার সেবা করতে লাগল। তার সেবা পেয়ে কয়েক দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠল মুক্তিযোদ্ধা।
বিকেল বেলা।
ফুলবাগানে পানি দিচ্ছিল মায়মুনা। পেছনে এসে দাঁড়াল মুক্তিযোদ্ধা ছেলেটা। দাঁড়িয়েই হাসল। সুন্দর হাসি। বলল, মায়মুনা।
বলুন।
আজ রাতেই আমাকে চলে যেতে হবে।
আজই?
হুমম।
আপনি তো এখনো পুরোপুরি সুস্থ হননি।
কিছু হবে না আমার। একবার যখন বেঁচে গেছি, তখন হাজারবার বাঁচব। দেশ স্বাধীন করেই ছাড়ব, ইনশা আল্লাহ।
মুক্তিযোদ্ধারা বুঝি এমনই হয়। খুব ভালো মানুষ। তাদের হৃদয়জুড়ে শুধুই দেশের প্রতি ভালোবাসা। তাইতো কেউ দেশের জন্য জীবন দিতে একটুও কুণ্ঠাবোধ করে না। মায়মুনা ছেলেটার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে আর এসব কথা ভাবে।
আর তখনই খটখট শব্দে বুটের আওয়াজ কানে আসে।
বাড়িতে মিলিটারিরা আসছে। বলল মায়মুনা। আপনি লুকান। তাড়াতাড়ি।
দৌড়ে ঘরে চলে গেল ছেলেটা।
চারজন মিলিটারি বাড়িতে এলো।
তুমিই মায়মুনা? নুরুর মেয়ে? একটা মিলিটারি বলল।
ঢোক গিলল মায়মুনা। জি।
তুমিই তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দাও? সেবা করো?
তোতলায় মায়মুনা। মা...নে...?
একজন বলল, আর ন্যাকামো করতে হবে না। চলো আমাদের সাথে। ক্যাম্পে। আজ থেকে তুমি আমাদের সেবা করবে।
এ কী বলছেন আঙ্কেল। আপনি তো আমার বাবার মতো...।
সে কথা শেষ করার আগেই বাড়িতে চলে এলেন নুরু। তিনি মসজিদে গিয়েছিলেন আসর নামাজ পড়তে। এসেই দেখলেন মিলিটারিরা জোর করে মেয়েকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত বেগে ছুটে এসে একটা মিলিটারির দুই পায়ে আছড়ে পড়লেন তিনি। হাতজোর করে বললেন, আমার মেয়েকে ছেড়ে দেন স্যার।
তুমি একটা গাদ্দার, শয়তান। বলল এক মিলিটারি। আমাদের সাথে কাজ করো আর ঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দাও? চিকিৎসা করো? মনে করো আমরা কিছুই খবর রাখি না? এসব কী বলছেন স্যার?
একজন বলল, গাদ্দারের সাথে কথা বলে কোনো লাভ নেই। তাকে উপড়ে পাঠিয়ে দাও, আর এই মেয়েটাকে নিয়ে ক্যাম্পে চলো।
সাথে সাথে একটা মিলিটারি এসে নুরুর বুক ঝাঁজরা করে দিলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল নুরু।
বাবা! চিৎকার করে উঠল মায়মুনা।
আর তখনই শুরু হলো গোলাগুলির শব্দ। অগ্নিচোখে এলএমজি বন্দুক নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মুক্তিযোদ্ধা কিশোর। শুরু করল এলোপাতাড়ি গুলি। তার সাথে পেরে উঠতে পারল না মিলিটারিরা। সব লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
মায়মুনার একটা হাত ধরল ছেলেটা। চলো।
মায়মুনা অবাক। কোথায়?
যুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে।
আমি!
হুমম, তুমি। তুমি মহিলা ক্যাম্পে থেকে যুদ্ধ করবে।
সেতাবগঞ্জ, দিনাজপুর


আরো সংবাদ



premium cement