১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

একজন গেরিলা যোদ্ধা পাঠক সংখ্যা

-

খোকা ম্যানেজার বললে লোকে চেনে। আশপাশের গ্রামেও এ নাম পরিচিত। পড়াশোনা শেষ করে সোনালী ব্যাংকে চাকরি নিয়েছিলেন। সর্বশেষ ম্যানেজার পদে পোস্টিং হন নিজ থানা রায়পুরায়। তখন থেকেই খোকা ম্যানেজার। খোকা ডাক নাম। মূল নাম রাফি উদ্দিন ভূঁইয়া। পিতা মো: হাসান উদ্দিন ভূঁইয়া। রায়পুরার মামুদপুরে জন্ম। এখন অবসরে আছেন।
শিক্ষা : পড়াশোনার হাতেখড়ি আরকেআরএম হাই ইশকুলে। ইশকুলের সেরা ছাত্র ছিলেন। টিচাররা ¯েœহ করতেন। ফুটবল ভালো খেলতেন। দূরেও খেলতে যেতেন। ক্লাস ফাইভ, এইট আর মেট্রিকে পেয়েছেন বৃত্তি। এইচএসসি ভর্তির সময় দোটানায় পড়েন। ভালো কলেজ খুঁজছিলেন। একদিন বাবা বললেন- কিশোরগঞ্জের মফস্বলে গুরু দয়াল কলেজে ভর্তি হতে হবে। ১৯৭০ সালে গুরু দয়ালে ভর্তি হন। থাকতেন কলেজ ছাত্রাবাসে। ‘কলেজের প্রায় সবাই তখন ছাত্রলীগ করে। পুরো কলেজেই তাদের প্রভাব। আমি করতাম ছাত্র ইউনিয়ন। আমার সাথে কয়েকজন ছিল। আমরা সভা সমাবেশের লিফলেট বিতরণ করতাম। বললেন খোকা ম্যানেজার।’
কলেজ ছুটি হয়ে গেল : ১৯৭০ নির্বাচন হয়। বাঙালিরা ভোটে জয়ী হয়েও ক্ষমতা পায়নি। বঙ্গবন্ধু আন্দোলনের ডাক দেন। দেশ তখন উত্তাল। সবখানে ভয়। খোকা তখন (এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের) ছাত্র। কলেজে ছুটি পড়ে। খোকা বাড়ি ফেরেন। অবসরে দিন রাত কাটে। মার্চ মাস আসে। ২৫ মার্চ গণহত্যার খবর পান। মনে দাগ কাটে। বুকে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে। বন্ধুদের আড্ডায় আলোচনা ওঠে। সবাই প্রতিশোধ নেয়ার প্রতিজ্ঞা করে। এভাবে আর বেঁচে থাকা যায় না। যুদ্ধ করতে হবে।
থেকে থেকে পাকবাহিনী রায়পুরায় আক্রমণ করে। খোকার পাশের গ্রাম জয়নগর, মেড়াতলীতে পাক বাহিনী নির্যাতন করে। খবর আসে। বন্ধুরা মিলে বাঁশ আর গাছের কাণ্ড দিয়ে হাতিয়ার বানান। প্রশিক্ষণ নেন। তখন পাড়ার অনেকে গোপনে ভারত যাচ্ছেন। তিনিও যেতে চাইলেন। কমিউনিস্ট পার্টির মোজাফফর ন্যাপের চিঠি আসে স্থানীয় নেতাদের কাছে। ট্রেনিংয়ে যেতে চাইলে যেন তৈরি থাকে। কমিউনিস্টের সবকিছু চলছিল পার্টির অধীনে।
বিদায় বেলা : খোকার মা বাবা রাজি হন না। একমাত্র ছেলে সে। খোকা একদিন বুদ্ধি আঁটলেন। মাকে জয়নগর মামাবাড়ি পাঠাবেন। সেখানে পাকবাহিনী অত্যাচার নির্যাতন করেছে। বললেনÑ মামাতো ভাই, অসুস্থ। তোমাকে যেতে বলেছে। মা সকাল সকাল গেলেন। সেখানে নির্যাতনের লোমহর্ষক কথা শুনলেন। পর দিন বাড়ি ফেরেন। খোকাকে বললেনÑ ‘তুই যুদ্ধ করবি। হায়েনাদের হত্যা করবি। ভারত যা। ট্রেনিং নিয়ে আয়।’ খোকা সাহস পেলেন। দুলাভাইকে দিয়ে বাবার নিকট তদবির করালেন। বাবা রাজি না হয়ে পারলেন না। বাবার অনুমোদন পেয়ে খন্দকার ফজলুল হক সাহেবকে বললেন স্লিপ দেন। কারণ রায়পুরার কমিউনিস্টের যারা ট্রেনিংয়ে যেত, তাদের খন্দকার সাহেব লিখিত স্লিপ দিতেন। আর তিনিই ছিলেন তখন রায়পুরার মুক্তিযোদ্ধের কারিগর। তিনি তাকে না করলেন। বললেন, তুমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। তোমার যেতে হবে না।’ বললাম, আমি যাবো, স্লিপ দিবেন কি না বলেন? তিনি দিলেন। মাকে বললাম কাল যাবো। পরদিন মা বাবাকে খাসির কলিজা আনতে বাজারে পাঠালেন। মা শুনেছিলেন পাঞ্জাবিরা খাসির কলিজা খেয়ে আনন্দ ফুর্তি করে। দুপুরে পেট পুরে খাসির কলিজা খেলাম। বিদায় নেয়ার সময় বাবার পায়ে ধরে সালাম করতে গিয়ে দেখি, বাঁশ পাতার মতো বাবার পা কাঁপছে। মা বিমূঢ়। দু’চোখে যেন অশ্রুবান ডেকেছে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আর যুদ্ধের জন্য বিদায় নেয়াটা সবচে বড় যুদ্ধ।’
ভারতের পথে : বাড়ি থেকে হেঁটে পৌঁছান আলগী। সন্ধ্যা নাগাদ এক লোকের বাড়ি অবস্থান করেন। সন্ধ্যায় ওঠেন এক নৌকায়। তখন পূর্ণিমা রাত। বাসনের মতো সাদা চাঁদ আকাশে। অগণিত তারা জ্বলছে আকাশে আর মেঘনা নদীতে। সন্তর্পণে নৌকা চলে। খুব ভোরে পৌঁছান কুমিল্লার ট্রাঙ্ক রোডে। কুমিল্লার ব্রিজ পার হয়ে আরেক নৌকায় ওঠেন। এক সময় সীমানায় পৌঁছে। ’ হাঁটু পর্যন্ত কাদামাটি পাড়ি দিয়েছি। দেখি, সে পথে অনেক নারী, যুবতী, বৃদ্ধরা পাড়ি জমাচ্ছেন। তাদের জন্য মায়া হলো। মেইন রোডে এসে গাড়িতে উঠি। পূর্ব থেকে সব রেডি ছিল। গাড়িতে করে আগরতলা পৌঁছায়। আগরতলা ৩ নম্বর বাড়ি। সেখানে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম আমাদের রিসিভ করেন। এলাকার অনেককে পেলাম। ইশকুল বন্ধুদেরও পেলাম। বড় ভাই বশির থাকত পাশের ক্যাম্পে। সেখানে আমরা মজা করতাম। সাত দিন পর প্লেনে করে আসামের তেজপুর গেলাম। ভারতীয় আর্মিরা ট্রেনিং দিত। ৪৫ দিন প্রশিক্ষণ নিই। আমরা ছিলাম ৪০০ জন। সবাই গেরিলা যোদ্ধা। আমরা শিখতাম, পাকবাহিনীর ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা, তাদের ভেতর ভয় ছড়ানো, আড়ালে থেকে বোমা ফোটানো ইত্যাদি। প্রয়োজনে মুখোমুখি আক্রমণের রণকৌশলও শিখি। ৪৫ দিন পর আবার আগরতলা আসি। সেখান থেকে ট্রেনে ধর্মনগর আসি। আমাদের সাথে সিলেটের সাবেক মেয়র কামরান ছিল। কমিউনিস্টের অনেক বড় নেতারাও ছিল। তারপর ট্রাকে করে তেলেমুড়া। সেখানে ছিলাম ১৫ দিন। বেজক্যাম্পও ছিলাম বেশ ক’দিন।
বাংলাদেশে : ব্যাজক্যাম্প থেকে মুক্তিবাহিনীকে দুভাগে দেশে পাঠানো হয়। প্রথম দল র্যাকি করে আসার মুহূর্তে পাকবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ হয়। ফেনীর বেতিয়ারায় সাত জন মুক্তিসেনা শহীদ হয়। খোকার গ্রামের দুজন ছিল শহীদী কাফেলায়। খোকারা রাতে ঢুকে। প্রথমে পৌঁছে ফেনী শহরে। খোকা বললেন- বেগমগঞ্জে আমরা এমবোস্ট করি। আমরা খবর পেলাম, পাশের গ্রামে পাঞ্জাবিরা আগামীকাল আক্রমণ করবে। আমরা তৈরি হলাম। তোড়জোড় প্রস্তুতি নিলাম আড়ালে থেকে আক্রমণের। পাঞ্জাবিরা খবর পেয়ে আক্রমণ করেনি। আমরা চৌমোহনীতে তাদের ওপর অ্যাটাক করেছি। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ ইশকুলে হোল্ড করেছি। আমাদের গন্তব্য ছিল গাজীপুরের কালীগঞ্জ আর আড়িখোলা। সেখানে আমাদের যুদ্ধ করার নির্দেশ। আমরা গাজীপুরের উদ্দেশে রওনা হই। বলে রাখি, আমি কিন্তু কমিউনিস্ট মুক্তিযোদ্ধা।’
বাড়ি ফেরা : ১৬ ডিসেম্বর। কাকডাকা ভোরে রায়পুরা পৌঁছান। মুসল্লিরা সবে মসজিদ ছেড়ে পথে নেমেছে। কমান্ডার বলল, যাদের বাড়ি কাছে, তারা আট ঘণ্টা সময় নিয়ে বাড়ি থেকে দেখা করে এসো। কমান্ডারের নির্দেশ পেয়ে এক দৌড়ে বাড়ি ফেরেন। পথে বাবাকে পেয়ে জড়িয়ে ধরেন। বাবা নিথর। বাবার চোখের পানি তাঁর কাঁধে পড়ছে। বাবাকে ছেড়ে আরেক দৌড়ে মায়ের কাছে ঘটেন। মা বোধহয় কিছু একটা করছিল। মাকে জড়িয়ে ধরলেন। মা হাউমাউ করে অবিরাম কাঁদছেন। বাড়ির বউ ঝিদের চোখেও পানি। দাদীরা গরম পানি আর দুধ ঢালছে মাথায়। এই প্রথম দুধ পানিতে গোসল করলেন খোকা। মা লোকমা দিয়ে খাওয়ালেন। খেয়ে বিদায় নিলেন। বিকালে নামতে হবে গাজীপুরের পথে। কমান্ডারের নিকট গিয়ে শোনেন দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আর যেতে হবে না। খোকা বললেনÑ আমি বন্দুক মাটিতে ফেলে দিই। বললাম, ধ্যাত, কিচ্ছু হলো না। পরিপক্ব হওয়ার আগেই বাচ্চা প্রসব হয়ে গেছে। কল্পনাও করেনি এত তাড়াতাড়ি দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। ভেবেছি আরো সময় লাগবে। আমি মনে করি, আমরা ভৌগোলিক স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু মানুষের সত্যিকারের স্বাধীনতা এখনো পাইনি।
ছবি : হিমেদুল ইসলাম শাওন


আরো সংবাদ



premium cement
ইরানে হামলা : ইস্ফাহান কেন টার্গেট? মাত্র ২ বলে শেষ পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টি জেলে কেজরিওয়ালকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দলের ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিকসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা তোকে যদি এরপর হলে দেখি তাহলে খবর আছে, হুমকি ছাত্রলীগ নেতার বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা করা হয়নি : প্রধানমন্ত্রী দাওয়াতী ময়দানে সকল নেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে : ডা. শফিকুর রহমান চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেল শ্রমিকদের মাঝে ইসলামের আদর্শের আহ্বান পৌঁছাতে হবে : ডা. শফিকুর রহমান ঢাকা শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে বিমানবন্দরের টার্মিনালে ঢুকে গেলো বাস, ইঞ্জিনিয়ার নিহত

সকল