২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

খেলনা পাঠক সংখ্যা

-

জানালার শিক ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে দিপু। মুক্ত আকাশে পায়রাদের দলবদ্ধ উড়ে বেড়ানো দেখছে আপন মনে। ভাবছে, ‘ইসস! যদি কবুতরের মতো উড়তে পারতাম, তাহলে দেইখা আইতাম বাজান কই আছে ’।
মসজিদে জুমার নামাজের আজান দিলো। কলপাড় থেকে মা হাঁক ছাড়ল, ‘বাবু! গোসল কইরা যা।
- ‘আইতাছি মা’। মায়ের ডাকে জবাব দিলো দিপু।
বাড়ির সবাই দিপুকে আদর করে বাবু ডাকে। দিপু দৌড়ে কলপাড় এলো। মা গায়ে পানি ঢেলে দিলো। লাল কসকো সাবানটা হাতে নিয়ে মাখতে শুরু করল দিপু। এই সাবানের ঘ্রাণটা দিপুর খুব পছন্দ।
- ‘আচ্ছা মা! আইজ তো শুক্কুরবার, বাজান আইব না’? সাবান গায়ে ডলতে ডলতেই জিজ্ঞেস করল দিপু।
- ‘তোর বাজানের শহরে মেলা কাম, এই কাম যেইদিন শেষ হইব সেইদিন আইব’! ছেলের প্রশ্নের উত্তরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল শিরিন। ‘তুই মসজিদে গিয়ে নামাজ পইড়া আল্লাহর কাছে দোয়া কর, দেখবি তোর বাপে ঠিক আইসা পড়ছে’। আশ্বাসের বাণী শোনাল ছেলেকে।
- ‘হাছা কইছ মা’।
ছেলের এই প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় না শিরিন। আসলে জবাব দেয়ার মতো কোনো জবাব নেই তার কাছে। শুনেছে শহরে যুদ্ধ লেগেছে। সে জানে না তার স্বামী এখন কোথায়! মেলেটারির গুলিতে মরে গেছে, নাকি এখনো বেঁচে আছে তার কাছে ফিরে আসার জন্য। দিপুকে গোছল করিয়ে মসজিদে পাঠিয়ে দিলো শিরিন। তিন সপ্তাহ হলো দিপুর বাবা শহরে গেছে। যাওয়ার আগে দিপুকে বলে গেছে, ‘আইতাছে শুক্রবার তোর জন্য খেলনা নিয়া আমু ’। সেই থেকে শুক্রবার এলেই দিপুর ছটফটানি শুরু হয়ে যায়, ‘কখন বাজান আইবো’ ‘কখন বাজান আইবো’। আজো এই নিয়ে মনে হয় শতবার মাকে একই কথা জিজ্ঞেস করেছে। নামাজ পড়ে ঘরে ঢুুকে আবারো বলল, ‘ওই মা! বাজান কখন আইবো’।
বিরক্ত হয়ে শিরিন বলল, ‘তোর বাজান কখন আইবো আমি জানি? তোর বাজানরে যাইয়া জিগা গা’।
মায়ের রাগ দেখে মন খারাপ হয়ে গেল দিপুর। এমনিতেই বাবার মতো অনেক জিদ্দি হয়েছে সে। মায়ের এমন ব্যবহার তার মোটেই ভালো লাগেনি।
জানালার শিক ধরে গাল ফুলিয়ে বাইরের আঁকাবাঁকা পথটার দিকে তাকিয়ে আছে দিপু। ধীর নয়নে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। ভাবনারা এসে ভিড় করছে তার মাথায়। মা এসে দু’-তিনবার খাওয়ার জন্য ডেকে গেছে, কিন্তু সে ফিরে তাকায়নি। ভাবনাদের সাথে খেলতে খেলতেই একসময় বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে দিপু।
‘দিপু! এই দিপু! দেখ, তোর জন্য খেলনা নিয়া আইছি! খেলবি না?
দিপু বাবার হাত থেকে খেলনা নিলো। আনন্দে পুরো বাড়ি দৌড়ে বেড়াতে লাগল। আর চিৎকার করে বলতে লাগল, বাজান আইছে, বাজান আইছে। ওর দৌড়াদৌড়ি দেখে বাজান হা হা করে হেসে বলছে, এই থাম থাম! পড়বি তো বাবু, থাম। দিপু বলছে, না আইজ আমারে কেউ থামাইতে পারব না। কিন্তু হঠাৎ করেই থেমে গেল দিপু। বাইরে ঠক ঠক আওয়াজ হচ্ছে। দৌড়ে বাবার কোলে এসে আশ্রয় নিলো দিপু। ভয়ে বলছে, বাজান বাইরে রাক্ষস আইছে আমারে বাঁচাও! আমারে বাঁচাও’।
ঝট করে ঘুম ভেঙে গেল দিপুর। পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে আছে। সময় বোঝার বয়স এখনো তার হয়নি। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। স্বপ্ন দেখছিল বুঝতে পারল। অন্ধকারে পাশে হাত বুলিয়ে দেখল মা নেই। এবার সত্যি ভয় পেয়ে গেল! চিৎকার করে ডাকল, মা মা ওই মা! তুমি কই? পাশের রুম থেকে কুপি হাতে দৌড়ে এলো শিরিন। দিপুকে জড়িয়ে ধরে বলল, এই তো বাবু! আমি এইখানে। কিচ্ছু হয় নাই ঘুমাও।
মায়ের কোমল পরশ পেয়ে আবারো ঘুমিয়ে পড়ল দিপু। পাশের ঘরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে শিরিন। দিপুর ঘন শ্বাসের শব্দ শোনার সাথে সাথেই শিরিন উঠে চলে এলো অন্ধকারে! পাশের ঘরে!

এক বছর পর
দিপু স্কুলে এসেছে। ওর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। হঠাৎ করেই একজন বলে উঠল, কিরে দিপু তোর আব্বা কি মইরা গেছে?
- ‘নাহ হ! কিল্লেই গা’? বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করল দিপু।
- কখনো তোর বাপরে দেখি নাই তো। শুনছি তোর বাপ নাকি যুদ্ধের সময় মইরা গেছে, তাই জিগাইলাম।
দিপু কিছুই বলল না। মন খারাপ হয়ে গেছে তার। সেই যে এক বছর আগে যুদ্ধের সময় ওর বাবা খেলনা আনবে বলে চলে গেছিল আর আসেনি। অভিমান করে বাবার কথা জিজ্ঞেস করা বাদ দিয়েছে সে। এখন আর বাবার কথা জিজ্ঞেস করে না মাকে। কিন্তু আজ আবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে। ক্লাস না করেই বাড়িতে এলো দিপু। এই সময়ে দিপুকে বাড়িতে দেখে অবাক হলো শিরিন।
- কিরে দিপু আজ স্কুল নাই? বন্ধ নাকি?
- নাহ হ!
ভালোকরে দিপুর চেহারার দিকে তাকিয়ে শিরিন বলল, বাবু তোর কী হইছে? মন খারাপ?
- ‘মা বাজান কই’? বলেই কেঁদে ফেলল দিপু।
ওকে জড়িয়ে ধরল মা। আদর করে বলল, ‘শুনবি, তোর বাপ কই’?
‘তোর বাপ সেই রাইতে আইছিল আমার কাছে। যেই রাইতে তুই রাগ কইরা ঘুমায়া পড়ছিলি। তোর বাপ যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বিদায় নিতে আইছিল। তারপর এই দেশরে হানাদার গো হাত থেইকা মুক্ত করতে চইলা গেছে যুদ্ধে। যাওয়ার আগে আমারে বইলা গেছে, তার স্বপ্নের কথা! বড় স্বপ্ন ছিল তার বাবু স্বাধীন দেশে মাথা উঁচা কইরা থাকব। সেই স্বপ্ন পুরা করতে হয়তো শহীদ হয়া গেছে তোর বাজান’।
কাঁদছে শিরিন, কাঁদছে দিপুও।
-তুমি আমারে ডাক দিলা না কেন মা?
- ‘তোর বাপ জিগাইল, দিপু কই? আমি কইলাম, তুমি খেলনা নিয়া আসো না কেন? এই জন্য রাগ কইরা ভাত না খাইয়াই ঘুমায়া গেছে বিকালে। খাড়াও আমি ডাক দেই। তোর বাপ আমার হাত টাইনা ধইরা কইল, থাক ডাক দিও না! আমি তো খেলনা আনি নাই। খেলনা না দেখলে ওয় আবার মন খারাপ করব। আমি ওর মন খারাপের চেহারা দেইখা কেমনে যুদ্ধে যামু কও। যদি বাইচা থাকি ওর সামনে খেলনা নিয়াই আমু।
এ জন্য আমি আর তোরে ডাক দেই নাই। তয়, তোর বাপে একটা জিনিস দিয়া গেছে তোরে, কইছে যেদিন তুই একটু বুঝবান হবি তখন যেন তোরে সেইটা দেই ’।
- কী দিয়া গেছে দেখি মা! অবাক হয়ে জানতে চাইল দিপু।
শিরিন আলমারি থেকে ভাজ করা একটা বাংলাদেশের পতাকা বের করে দিপুর হাতে দিলো। দিপু স্বাধীন দেশের স্বাধীন পতাকা হাতে নিয়ে কাঁদছে। তার জীবনের সবচেয়ে বড় খেলনা, সবচেয়ে বড় উপহার তার বাবা তাকে দিয়ে গেছে।
পতাকা বুকে জড়িয়ে ধরে দিপু মাকে বলছে, ‘মা! আমার আর কখনো খেলনা লাগব না’!

 


আরো সংবাদ



premium cement
মেক্সিকোয় মেয়র প্রার্থী ছুরিকাঘাতে নিহত রাজশাহীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজসমূহেও ক্লাস বন্ধ ঘোষণা দেশীয় খেলাকে সমান সুযোগ দিন : প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিবাদের শোষণ থেকে জনগণকে মুক্ত করতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : মিয়া গোলাম পরওয়ার সিংড়ায় প্রতিমন্ত্রীর শ্যালককে প্রার্থীতা প্রত্যাহারের নির্দেশ আ’লীগের চুয়াডাঙ্গায় হিট‌স্ট্রো‌কে যুবকের মৃত্যুর ৭ ঘণ্টা পর নারীর মৃত্যু ঢাকায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়াল, যশোরে দেশের সর্বোচ্চ ৪২.৬ শ্যালকদের কোপে দুলাভাই খুন : গ্রেফতার ৩ তীব্র গরমে কী খাবেন আর কী খাবেন না এবার তালতলী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল

সকল