২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সকাল-সন্ধ্যা : চারাগল্প

-

জীবনে এই প্রথমবারের মতো ঢাকায় যাচ্ছেন আলতাফ মিয়া। ইয়াসিন অবশ্য এর আগে বেশ কয়েকবার ঢাকায় গেছে বিভিন্ন কাজে। আজ যাচ্ছে বাবাকে নিয়ে। আলতাফ মিয়া অনেক দিন ধরে অসুস্থ। ছেলে ইয়াসিনের আবদারে আজ তিনি ঢাকায় যাচ্ছেন ভালো ডাক্তার দেখাতে। বাসের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্যগুলো বড় ভালো লাগছে আলতাফ মিয়ার। বহু বছর পর আজ তিনি বাসে উঠেছেন। বাসে উঠার পর তার কাছে মনে হলো তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছেন। একবার ইয়াসিনকে বললেন, ‘বাপজান, আমার রোগ সেরে গেছে। শহরে যাওয়ার দরকার নেই।’ ইয়াসিন বাবার কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে বলল, ‘না না বাবা। আপনাকে ডাক্তার দেখাতেই হবে। দুই দিন পরপর অসুস্থ হয়ে যান।’ ছেলের কথা শুনে আনন্দে বুকটা ভরে গেলো আলতাফ মিয়ার। অথচ তিনি জানেন না ছেলে তাকে কী উদ্দেশ্যে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে। জানলে কখনোই বাসে উঠতেন না।
ইয়াসিন চিকিৎসার নাম করে বাবাকে শহরে নিয়ে রাস্তায় একলা রেখে গোপনে পালিয়ে আসবে। তারপর গ্রামে এসে গুজব রটাবে যে শহরে যাওয়ার সময় বাস অ্যাক্সিডেন্টে বাবা মারা গেছেন। সবাই এই মিথ্যাকে সত্য ভাববে। এসব ফন্দি মাথায় আনতে ইয়াসিনকে সাহায্য করেছে তার স্ত্রী রোজিনা। এক বছর আগে শাশুড়ির মৃত্যুর পর শ্বশুরকে সহ্য করতে পারে না রোজিনা। বুড়ো মানুষটাকে সংসারের বোঝা ভাবতে শুরু করে। তার ওষুধ কিনতে গিয়ে স্বামী ইয়াসিনের কত টাকা নিপাত যায়। এসব দেখতে ভালো লাগে না রোজিনার। ফলে সে ইয়াসিনকে শ্বশুর সম্পর্কে উল্টাপাল্টা যুক্তি দিতে থাকে। চিরকাল বাবা ভক্ত ইয়াসিন বউয়ের তালে পড়ে বাবাকে আগের মতো সম্মানের চোখে দেখে না। গত কয়েক দিন আগে স্ত্রীর শিখিয়ে দেয়া এই ভয়াবহ ফন্দিতে আটকে ইয়াসিন এখন বাবাকে নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছে চিকিৎসার নাম করে। তারপর সেখানে অচেনা কোনো রাস্তায় বাবাকে একা রেখে পালিয়ে আসবে।
২.
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে একটা রিকশা ভাড়া করে বাবাকে নিয়ে রিকশায় চেপে বসে ইয়াসিন। জীবনে প্রথমবারের মতো ঢাকায় এসে আলতাফ মিয়ার চোখে রাজ্যের মুগ্ধতা। এত বড় বড় দালান, এত এত মানুষ, এত গাড়ি-ঘোড়া দেখতে বড় ভালো লাগছে তার কাছে।
রিকশা এসে থামে ফার্মগেট ওভারব্রিজের কাছে। ভাড়া পরিশোধ করে বাবাকে নিয়ে রিকশা থেকে নেমে ওভারব্রিজের ঠিক মাঝখানে চলে আসে ইয়াসিন। মাথার ওপর পড়ন্ত দুপুরের গরম সূর্য। বাবা-ছেলে ঘামে ভিজে জবুথবু। ইয়াসিন ক্ষীণ গলায় বাবাকে বলে, ‘এখানে আপনি পাঁচ মিনিট দাঁড়ান। আমি নিচ থেকে আসছি।’ আলতাফ মিয়া কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলেন, ‘ঠিক আছে বাবা।’
ওভারব্রিজ থেকে নিচে নেমে আসে ইয়াসিন। বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে আবার সায়েদাবাদের উদ্দেশে রওনা দেয়। তারপর সেখান থেকে বাসে চেপে বসে গ্রামের উদ্দেশে রওনা দেবে। গ্রামে গিয়ে গুজব রটাবেÑ বাবা শহরে যাওয়ার পথে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে।
৩.
দশ গেরামের মানুষ আজ আলতাফ মিয়ার বাড়িতে। বাড়ি ভরা শোক। ইয়াসিনের মুখে দুর্ঘটনার বর্ণনা শোনে সবাই আলতাফ মিয়ার শোকে কাতর। ইয়াসিন যতবার কান্নার অভিনয় করছে, গ্রামবাসী ততবার তাকে সান্ত্বÍনার বাণী শোনাচ্ছে। সে গ্রামে এসে গুজব রটিয়ে বলে, মেঘনা সেতু থেকে বাস উল্টে নদীতে পড়ে যায়। ইয়াসিনসহ বেশ কয়েকজন জান নিয়ে বাস থেকে বের হতে পারলেও বাকিরা রক্ষা পায়নি। সবার সামনে এই ঘটনা বারবার পেশ করে ইয়াসিন নিখুঁতভাবে কান্নার অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে। রোজিনাও শ্বশুরের স্মৃতিচারণ করে নকল শোকে আচ্ছন্ন।
৪.
পরদিন বিকেলে ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। এই গ্রামের ছেলে দাউদ, যে ঢাকায় সরকারি চাকরি করে, সেই দাউদের সাথে আলতাফ মিয়াকে গ্রামে আসতে দেখে পুরো গ্রামবাসী আশ্চর্য। আলতাফ মিয়া ফিরে এসেছেন কী করে! তিনি নাকি বাস উল্টে নদীতে পড়ে...
এসব কথা শোনে আকাশ থেকে পড়ল আলতাফ মিয়া আর দাউদ। দাউদ সবাইকে জানায়, ‘চাচাকে ফার্মগেট ওভারব্রিজে দেখলাম বিকেলে। বসে বসে কাঁদছেন। ইয়াসিন নাকি নিচে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। আমি চাচাকে বাসায় নিয়ে যাই। আজ গ্রামে নিয়ে এসেছি।’
গ্রামবাসী ইয়াসিনের কথার সাথে দাউদের কথার মিল পায় না। তারা সবাই আলতাফ মিয়াকে তার বাড়িতে নিয়ে আসে। রোজিনা আর ইয়াসিন বাবাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে। আলতাফ মিয়া ইয়াসিনকে জড়িয়ে ধরে কান্না গলায় বলেন, ‘কই গেলি বাপ! আমি সারাদিন অপেক্ষায় ছিলাম।’ আলতাফ মিয়া এখনো জানেন না ছেলে তার সাথে কী নাটক করেছিল।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী


আরো সংবাদ



premium cement