২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাঙ্গির গ্রাম ভাঙাভিটা

-

ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার ইছামতি নদীর কূলঘেঁষে গড়ে উঠা গ্রামের নাম ভাঙাভিটা। প্রায় ২০০ বছর আগে এখানে মানুষের বসতি শুরু হয়। এ গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। কৃষির ওপর ভিত্তি করেই একসময় জীবন-জীবিকা শুরু হয় এখানকার মানুষজনের। এ গ্রামে প্রায় আট হাজার মানুষের বসবাস। সারা বছরই কোনো না কোনো ফসলের আবাদ করে থাকেন এ গ্রামের কৃষক-কৃষাণীরা। কৃষিই এ অঞ্চলের মানুষের প্রাণ। বছরের বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন ফসল উৎপাদন ও বিপণনের মধ্য দিয়ে চলছে তাদের জীবনের রসদ। একসময় ভাঙাভিটা এলাকায় ধান, পাট ও সবজিসহ অন্যান্য ফসল আবাদের মাধ্যমে কৃষিকাজের গোড়াপত্তন হলেও বাঙ্গি চাষের পর থেকে পাল্টে যায় জীবনচিত্র। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি মেলে বাঙ্গি চাষের মাধ্যমে। দ্রুত বদলাতে থাকে এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান। একসময় এ এলাকার মানুষ অবহেলিত থাকলেও শিক্ষা-দীক্ষায়, খেলাধুলায়, সংস্কৃতি, সামাজিকতা এমনকি রাজনীতির ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই অন্যদের চেয়ে।
সারা দেশে বিভিন্ন জাতের বাঙ্গির দেখা মিললেও ভাঙাভিটার বাঙ্গির সুনাম অনেক আগে থেকেই। ভাঙাভিটার বাঙ্গির স্বাদ একবার যে নিয়েছে, সে বারবার খুঁজে ফিরবে এটিই স্বাভাবিক। তাই চাহিদার কথা বিবেচনা করে ভাঙাভিটা এলাকার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে আবাদ করা হয় মওসুমি ফল বাঙ্গির। ভাঙাভিটায় দৃষ্টি যত দূর যায়, চোখে পড়ে শত শত বিঘা বাঙ্গির ক্ষেত। বাতাসের সাথে নাকে ভেসে আসে বাঙ্গির ঘ্রাণ। স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় ভাঙাভিটার বাঙ্গি। যে কারণে সারা দেশের মানুষের কাছে ভাঙাভিটার বাঙ্গির চাহিদাও ব্যাপক। জানা যায়, এ বছর ভাঙাভিটা এলাকায় প্রায় দুই হাজার বিঘা জমিতে বাঙ্গির চাষ করা হয়েছে। অনুকূল আবহাওয়া থাকায় এ বছর বাঙ্গির বাম্পার ফলন হয়েছে। বাংলা সনের কার্তিক মাসের মাঝামাঝি সময় বপন করা হয়ে বাঙ্গির বীজ। আড়াই থেকে তিন মাসের মধ্যেই প্রতিটি গাছে ফল ধরতে শুরু করে। সে হিসাবে, মাঘ মাসের মাঝামাঝিতে বাঙ্গির দেখা মেলে। লতাজাতীয় বাঙ্গি গাছ দুই থেকে তিন হাত পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। শিলাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টি বাঙ্গি চাষের জন্য অনুপযোগী। বাঙ্গির পুষ্টিগুণ অনেক।
গাছের আয়ুষ্কাল খুবই কম। ফল ধরা থেকে শুরু করে দেড় থেকে দুই মাস পর্যন্ত বাঙ্গি তোলা যায় ক্ষেত থেকে। এ সময় স্থানীয় হাটবাজারগুলো বাঙ্গির গন্ধে ভরে ওঠে। মওসুমি ফল হওয়ায় অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে এমনকি আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে পাঠানো হয় বাঙ্গি।
ভাঙাভিটার বাঙ্গির চাহিদা থাকায় রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি জেলার পাইকারদের মাধ্যমে পৌঁছে যায় বাঙ্গি। এখানকার উৎপাদিত বাঙ্গির হাট বসে প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত। পাইকাররা বাঙ্গি কেনার উদ্দেশে খুব ভোর থেকে আসতে শুরু করেন ভাঙাভিটার ট্রলার ঘাটে। সারি সারি ছোট-বড়-মাঝারি ট্রলার আর ডিঙ্গিনৌকা ইছামতি নদীর ঘাটে অবস্থান নিলে তখন দেখতে খুবই চমৎকার লাগে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের মিলনমেলায় পরিণত হয় ভাঙাভিটার বাঙ্গির হাট। কাঁচা বাঙ্গি সবুজ হলেও পাকা বাঙ্গি হলদে হয়, আর হদুল রঙের আভায় চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসে। কৃষকের মনকে উদ্বেলিত করে তোলে সোনালি ফসলের হাসি। এমন মনকাড়া দৃশ্য দেখতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে ভাঙাভিটায়।
বাঙ্গিচাষিরা আগের দিন ক্ষেত থেকে বাঙ্গি তুলে চারি ভর্তি করে পরের দিন সকালে হাটে নিয়ে আসেন। একটি চারিতে ছোট-বড় মিলিয়ে ৩০-৩৫টি বাঙ্গি ধারণ করে। এক চারি বাঙ্গি বিক্রি হয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। একজন বাঙ্গিচাষি প্রতিদিন ১০-১২ চারি বাঙ্গি বিক্রির জন্য হাটে নিয়ে আসেন।
কথা হয় ভাঙাভিটা এলাকার বাঙ্গিচাষি রবীন্দ্র সরকারের সাথে। এ বছর তিনি ১২ বিঘা জমিতে বাঙ্গির চাষ করেছেন। ফলনও অনেক ভালো হয়েছে। প্রতিদিন তিনি ১০ চারি বাঙ্গি হাটে নিয়ে আসেন। দামও এবার ভালো পাচ্ছেন। তিনি জানান, বাঙ্গি চাষে ব্যয় কম, আয় তুলনামুলক অনেক বেশি। এ জন্য এখানকার চাষিরা দিন দিন বাঙ্গি চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। সরকার সুদমুক্ত ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করলে আরো ব্যাপক বাঙ্গির চাষ করা সম্ভব।
সুবোধ সরকার বলেন, নানা প্রতিকূলতা উপক্ষো করে প্রতি বছরই এখানকার কৃষক বাঙ্গি চাষ করে থাকেন। সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকার কারণে তারা বাঙ্গির ন্যায্যমূল্য পান না। তাই তাদের দাবি, ভাঙাভিটায় ইছামতি নদীর ওপর একটি ব্রিজ নির্মাণ করে দিলে দূরদূরান্ত থেকে পাইকাররা সরাসরি এ হাটে আসতে পারত তাতে বাঙ্গির আরো ভালো দাম পাওয়া গেলে আরো লাভবান হতেন বলে আশা ব্যক্ত করেন তারা।
আবার অনেকে অভিযোগ করে বলেন, বাঙ্গিতে অনেক সময় বিভিন্ন পোকামাকড় ও রোগবালাই দেখা দেয়। কিন্তু কৃষি কর্মকর্তাদের সময়মতো কৃষিপরামর্শ না পাওয়ায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে থাকে। ফলে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। বালাইনাশক বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করলেও তা প্রয়োগের সঠিক কোনো নিয়ম জানেন না বিধায় যথাযথ প্রতিকার পান না বলেও অভিযোগ করেন তারা। এখানকার বাঙ্গিচাষিদের মনোবল খুবই দৃঢ়। যতই ঝড়ঝঞ্ঝা আসুক না কেন, শত বাধা অতিক্রম করে যুগ যুগ ধরে বাঙ্গির চাষ করে যাচ্ছেন ভাঙাভিটার চাষিরা। নিজেদের ঐতিহ্যের ফসল হিসেবে এবং অর্থনৈতিকভাবে মুক্তিলাভের জন্য আগামী দিনগুলোতেও চাষ করবেন গ্রীষ্মকালীন ফল বাঙ্গির।


আরো সংবাদ



premium cement