২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

জিলাপি : চারাগল্প

-

চারদিক জুড়ে হইচই পড়ে গেছে। গ্রামের আঁকা-বাঁকা পথ দিয়ে পিঁপড়ার মতো মানুষ আর মানুষ।
নানা রকমের মানুষ, কালো, বেঁটে, ফর্সা, শ্যামলা, জওয়ান-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ কেউ কারো খোঁজ নেয়ার সময় পাচ্ছে না নিজেদের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে। সবাই চলছে উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যে।
কেউ বা মাথায় পোটলা নিয়ে চলছে,
কেউ বা পুরনো ট্রাঙ্ক টা নিয়ে চলছে
কেউ কাঁধে একটা ঝোলা নিয়ে চলছে কেউ বা কোমরে।
যে যেভাবে পারছে শুধু নিরাপদ আশ্রয় আর নিরাপত্তা খুঁজে চলেছে।
আট বছরের শিশু সিফু মাকে এসে বলছে,
Ñমা, মা, মানুষগুলো পিঁপড়ার দল হয়ে যাচ্ছে ক্যান?
ও তুই বুঝবি না রে বাজান।
সিফু : আচ্ছা মা মিলিটারি কী মা? সবাই কইতাছে মিলিটারি সবাইকে মাইরা ফালাইতেছে? আমাগোও কি মাইরা ফালাইব?
মা : এসব কইতে নাই রে বাজান, আয় মায়ের বুকে আয়!
সিফু : মা মিলিটারি দেখতে কেমন?
মা : মিলিটারি দেখতে ঠিক মাইনসের মতোই, কিন্তু মানুষ না ওরা হায়েনা। ওদের বড় বড় গোঁফ থাকে তেমন ওদের মনডাও শক্ত। ওদের বড় বড় বন্দুক থাকে রে বাজান, হুনছি মানুষ দেখলে টুস করে পাখির মতো মাইরা ফালায়।
তোকে আর কিছু জানতে হইব না বাজান, চল তো গোসল করাইয়া দেই।
সিফু : মা আমার প্যাটটা খাই খাই করতাছে?
মা : গোসলডা কইরা খাবি।
সিফুর গোসল শেষ।
সিফু গা টা একটু গরম জ্বর আসে যদি এই ভেবে মা সরিষার তেল গায়ে মেখে দিলো।
রাস্তা দিয়ে দলে দলে লোক যাচ্ছে সেøাগান দিচ্ছে।
Ñসিফু পিঁড়ি নিয়ে আয় রোধে বইসা ভাত চারডে খা বাজান রাতে ভাত নেই।
তোর বাপ চাল নিয়ে আসবে তারপর।
সিফু : মা রাস্তায় রাস্তায় সেøাগান হচ্ছে, কইতাছে জয় বাংলা।
কেন কইতেছে মা?
মা : বাজান মিলিটারি রা আমাগো বাংলা ভাষা কাইড়া নিতে চায়। আমাগো বাংলারে কাইরা নিতে চায়।
সেই জন্য সক্কলে মিইলা ওই সেøাগান দিচ্ছে
বলছে জয় বাংলা।
সিফু : আব্বাজান কই গেছে মা, আমি গরম জিলাপি আনতে কইসি; এহনো আহে না ক্যা?
মা : আইবো বাজান, কাম শ্যাষ করি আইবো।
সিফুর খুব গরম জিলাপি পছন্দ। এই গরম জিলাপির জন্য গঞ্জের হাঁটে গিয়া হারাইয়া গেছিল।
অনেক খোঁজাখুঁজি কইরা পাওয়া গেছে।
জলিল মিয়া কাজ শেষ করে ছেলের জন্য গরম জিলাপি আর গামছার মধ্যে অল্প চাল নিয়া বাড়ি ফিরল।
ফিরতে দেরি হওয়ায় সিফু ঘুমিয়ে পড়েছে।
উঠানে দাঁড়িয়ে জলিল মিয়া ডাকতাছে?
Ñসিফু বাপজান কই?
Ñসিফু ঘুমাইছে, আপনে হাত-মুখ ধুয়ে আহেন, পান্তা আছে খাইয়া লন।
Ñরাহেলা গরম ভাত রান্ধ নাই? এই ঠাণ্ডায় পানি থেকে উঠয়া আইয়া পান্তা ভাত খাইতে ইচ্ছা করে না।
Ñচাল আছিল না সিফুর বাপ, তাই রান্ধি নাই আপনে একটু খাড়ান আমি ভাত রাইন্ধা আনি।
Ñনা থাক, এত রাইতে ঘরের বাইরে যাওন ভালো হইব না। যা হুনলাম, আমাদের গঞ্জেও মিলিটারি আইয়া পড়ছে।
শুধু পোলাডারে লইয়া চিন্তা, আমরা যদি না থাকি ওর কী হইব।
Ñসিফুর বাপ এত চিন্তা কইরেন না, সব ঠিক হইয়া যাইব।
পরদিন সকালে হইচই বেড়ে গেল। সেøাগানের হইচই, তবে দিন যইত বাড়ছে সেøাগান বাড়ছে, সকাল থেকে যতই বিকেল হচ্ছে বাড়ছে গ্রামের থমথমে পরিবেশ।
গ্রামের ছেলেদের আড্ডা দেয়া, একখানে অনেকে বসে গল্পগুজব করা সব যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।
গ্রাম ছেড়ে প্রায় চলে যাচ্ছে সবাই।
সবার মুখ যেন ফ্যাকাসে রঙের।
Ñসিফুর বাবা এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম বসিয়ে এসেছে।
Ñসিফু বাপজান, আমি যুদ্ধে যাই রে বাপ
তোর মায়ের কথা হুনবি।
সিফু : আব্বা যুদ্ধে যাও কেন?
Ñবাপজান ওই যে মিলিটারি আইছে, ওদের মারতে হইব।
যাওয়ার সময় বেশ কিছু চাল-ডাল কিনে দিয়ে গেল।
আর সিফুর জন্য একটা পতাকা।
গ্রামে অনেক লোকজন মিলিটারির হাতে ধরা পড়েছে। কেউ মারাও গেছে। সবাই পালিয়ে যাচ্ছেÑ কেউ নদী পার ওপারে যাচ্ছে।
কেউ পাশের গ্রামে।
Ñসিফু তাল গাছ টার নিচে বসে মানুষের ছোটা ছুটি দেখছে।
একদিন বিকেলে সিফু চুপি চুপি মিলিটারির ক্যাম্পে যায়। গিয়ে দেখে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে লোকজনদের দাঁড় করিয়ে রেখেছে পেছনে হাত বাঁধা।
সিফুর চোখের সামনেই টুস করে পাখির মতো কতগুলো মানুষকে মেরে ফেলল।
সিফু হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি ফিরল, দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বললÑ
Ñমাগো মা, ওরা টুস করে করে অনেক লোককে মারছে।
মাটিতে খালি লাল রক্ত পানির মতো ঢেউ খেলতাছে।
মা : তুই মিলিটারি ক্যাম্পে গেছিলি?
সিফু : হ, গেছিলাম।
ছেলেকে জড়িয়ে ধরে,
রাহেলা বেগম কেঁদে কেঁদে রাহেলা বলছে, আর যাবি না বাপ তোকে দেখে পাখির মতো মাইরা ফালাইব।
রাতে মিলিটারি আসে সিফুদের বাড়িতে
সিফুদের প্রতিবেশী এসে সকালে বলে গেছে সাবধানে থাকতে। তাই সিফুর মা ও সিফু পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেছে।
মিলিটারি কাউকে না পেয়ে ঘরটা জ্বালিয়ে দেয়।
সিফুর মা সিফু পালিয়ে প্রাণে বাঁচে।
নদী পার হয়ে ওপারে পৌঁছে গেছে সিফুরা, সিফুর বাপ ওই যে যুদ্ধে গেছে আর খোঁজখবর নেয়নি।
কয়েকদিন ধরে বেশ নিরাপদে আছে সবাই নদীর এপারের গ্রামে এখনো মিলিটারি আসেনি।
তবে দু’দিন ধরে সিফু বায়না ধরেছে গরম জিলাপি খাবে।
সিফুর মা কোনোরকমে বুঝ দিয়ে রাখছে।
Ñমা আমি খেলতে যাইতাছি?
বাপজান আইলে আমারে ডাকিও।
সিফু পতাকা নিয়ে খেলছিল, হঠাৎ একটা কি যেন সিফুর বুকের ভেতর ডুকে পড়েÑ
চারদিকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে,
সিফুর মা দৌড়ে আসে, বুলেটবিদ্ধ সিফুকে বুকে জড়িয়ে নেয়। তোতলাতে তোতলাতে ক্ষীণস্বরে সিফু বলে
মা হায়েনা আমাকে পাখি ভেবে টুস করে মেরে দিলো, বাপজান কখন জিলাপি নিয়ে আসবে মা।
অঝোরে কাঁদতে থাকে সিফুর মা,
চিৎকার করতে পারছে না, সেই যে সিফুর বাবা যুদ্ধে গেছে আর ফেরেনি গরম জিলাপি নিয়ে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার সাতচল্লিশ বছর হয়ে গেল।
এখনো সিফুর মা মাঝে মধ্যে সিফু বলে ডাকে আর গরম জিলাপি চায়, দোকানে দোকানে।
কেউ জিলাপি দিলে নিয়ে ছেঁড়া শারীটায় লুকিয়ে রাখে সিফুর জন্য।
আর বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে পান্তা চায়, সিফুর বাপকে মাঝে মধ্যে ডাকে পান্তা ভাত খাওয়ার জন্য, কেউ আসে না।
একা একা বিড়বিড় করে বলে
সেই যে সিফুর বাপ যুদ্ধে গেল, আর ফিরল না!
সিফু বাজান কই গেলি
জিলাপি তো ঠাণ্ডা হইয়া যাইবো রে বাজান।
কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ


আরো সংবাদ



premium cement
রাশিয়া সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টে ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৩৬ সেনা সদস্য দৌলতদিয়া ঘাটে পন্টুন থেকে নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু অ্যানেসথেসিয়ার পুরনো ওষুধ বাতিল করে কেন নতুনের জন্য বিজ্ঞপ্তি! বাইডেনের মেয়াদে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতির কোনো আশা নেই : রুশ রাষ্ট্রদূত ডিএমপির অভিযানে গ্রেফতার ৪০ নিউইয়র্কে মঙ্গোলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ফ্ল্যাট জব্দ করবে যুক্তরাষ্ট্র! টাঙ্গাইলে লরি-কাভার্ডভ্যান সংঘর্ষে নিহত ১ জিম্বাবুয়ে সিরিজে অনিশ্চিত সৌম্য বেনাপোল সীমান্তে ৭০ লাখ টাকার স্বর্ণের বারসহ পাচারকারী আটক ৪ বিভাগে হতে পারে বজ্রসহ বৃষ্টি!

সকল