২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বইয়ের মানুষ পলান সরকার

-

সময়টা এমন যে, বাঙালিরা নতুন বই নিয়ে আনন্দ-উল্লাস করছে। কৃষকের ঘরে যখন নতুন ধান আসে, তখন তারা যাপিত কষ্টকে বিসর্জন দিয়ে মুখে হাসি ধরে রাখে। তেমনি লেখকেরা যখন তার কালো কালির কলমে লেখাসমগ্র বইয়ের মলাটে আবদ্ধ দেখে, তখন যেন লেখালেখির সার্থকতা খুঁজে ফেরে। এই সার্থকতার জোগান দিয়ে থাকে অমর একুশে বইমেলা। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে লেখকদের অনুপ্রেরণা দিতে বইমেলা ফিরে আসে। আগামীতেও ফিরে আসবে। কিন্তু আর কোনো দিন এ পৃথিবীতে ফিরে আসবে না একজন বইয়ের ফেরিওয়ালা পলান সরকার। তিনি এখন ভিন্নলোকে। গেরুয়া পাঞ্জাবি পরে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে, হাতে দু’খানা বই নিয়ে দুপুরের রোদ-বৃষ্টি পেরিয়ে কেউ আর ডাকবে নাÑ ‘পড়বি কে কে, আয়রে তোরা, আয়।’
বইপ্রেমী পলান সরকারের নাম মানুষের মুখে মুখে। কে তাকে চেনে না? কেউ যদি বলে, ‘বইয়ের ফেরিওয়ালা কে’? অনায়াসে সবাই বলবে, ‘পলান সরকার’। কেউ যদি বলে, ‘আলোর ফেরিওয়ালা কে’? তবুও অনায়াসে সবাই বলবে, ‘পলান সরকার’। তিনি বইয়ের আলোয় সমাজকে আলোকিত করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ছোট বড় সবার দোরগোড়ায় বই পৌঁছে দিতেন। এতেই তার আত্মতৃপ্তিবোধ যে মানুষ বই পড়ার অভ্যাসকে চিরদিন ধরে রাখুক। প্রযুক্তির আগ্রাসনে বই পড়া যাতে বন্ধ হয়ে না যায়, মানুষ যেন বই পড়া বন্ধ না করে, তার স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কাজের মাধ্যমে তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। এমন পলান সরকার একাই যেন কয়েক শ’ আলোকবর্তিকা।
পলান সরকারের কাজের মূল্যায়ন আমাদের সুশীলসমাজ করেছে। তার চলে যাওয়ায় অসংখ্য মানুষের অন্তর শিহরিত। অশ্রু ঝরেছে শত শত মানুষের। অনেক আগেই বাংলাদেশ সরকারও তাকে যথাযথ মূল্যায়ন করেছে। নিজের টাকায় বই কিনে পাঠকের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বই পড়ার একটি আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ২০১১ সালে তাকে সমাজসেবায় একুশে পদকে সম্মানিত করা হয়েছে। তিনি চিরজীবন সম্মানিত হয়ে থাকবেন। পৃথিবীতে যারা বইকে ভালোবেসেছেন, তারা স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। তার ব্যতিক্রম পলান সরকার হবেন না। মৃদুপায়ে হেঁটে চলা ‘বইয়ের মানুষ’ আমাদের সবুজ পৃথিবীর বুকে হাঁটবেন, যত দিন আমরা বইকে আমাদের অন্তরে আগলে রাখব, বই পড়ার অভ্যাস লালন করব।
পলান সরকার ১৯২১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম ছিল হারেজ উদ্দিন। তবে পলান সরকার নামেই তাকে আশপাশের সব মানুষ চিনত। সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, জন্মের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় তার বাবা মারা যান। তার জীবন হারিয়ে ফেলে পিতৃস্নেহ। টাকা-পয়সার টানাটানির কারণে তাকে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময়ই একাডেমিক পড়াশোনায় ইতি টানতে হয়। তবে তিনি দমার পাত্র ছিলেন না। দৃঢ় মনোবল নিয়ে নিজের চেষ্টাতেই পড়ালেখা চালিয়ে যান। বই তাকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে। প্রতিষ্ঠানের মায়া কাটিয়ে উঠলেও বইয়ের পিছু ছাড়তে নারাজ। সময়টা যদি এখন হতো, হয়তো পলান সরকার তার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পারতেন। হয়তো তিনি একজন আনিসুজ্জামান, আবু সাঈদ কিংবা বিশেষ কেউ হতেন। তবে ভাগ্য তাকে যেখানেই নিয়ে যাক না কেন, বই থেকে বিতাড়িত করতে পারেনি বলে আজ পলান সরকার একজন আলোচিত, আলোকিত ও সোনার মানুষ। তাকে নিয়ে আমরা গর্বিত।
পলান সরকার একজন অসম্ভব বইপাগল মানুষ ছিলেন। এমন মানুষ পৃথিবীতে সত্যিই বিরল। জানা যায়, তিনি স্থানীয় একটি উচ্চবিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ছিলেন। প্রতি বছর বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যারা প্রথম থেকে দশের মধ্যে মেধা তালিকায় স্থান পেত, তাদেরকে তিনি একটি করে বই উপহার দিতেন। এখান থেকেই তার বই বিতরণের অভিযান শুরু হয়। তার হাত থেকে বই প্রাপ্তির আগ্রহবোধ শিক্ষার্থীদের মাঝে বেড়ে যায়। এরপর তিনি সবাইকে বই দিতে থাকেন। এ বই দেয়ার রেওয়াজ দু-এক বছরের নয়, তিনি একটানা তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে বই বিতরণের কাজ করেছেন। বইয়ের পাতার সুঘ্রাণ পাইয়ে দিয়ে মানুষের মন জয় করেছেন। তার চেতনাবোধ ছিলÑ নিজে বেশি দূর পড়তে পারিনি। আমার মতো যেন কেউ এমন না হয়। বইয়ের অভাবে যেন অজানা না থেকে কেউ। তার সাধ্য তাকে সাহস জুগিয়েছে।
পলান সরকার ছিলেন সেই জাতের মানুষ সমাজকে আর একটু এগিয়ে নেয়ার জন্য নিজের সবটুকু সামর্থ্য ঢেলে দেন। মানুষ যে আলোকিত করার জন্য হেঁটে হেঁটে বই বিলির কাজ শুরু করেন। এমনিভাবে রাজশাহী অঞ্চলের বেশ কয়েকটি গ্রামজুড়ে তিনি গড়ে তোলেন বই পড়ার এক অভিনব আন্দোলন। তার কথা গণমাধ্যমে উঠে আসে। বিশ্ববাসীও জানে একজন সাদা মনের মানুষের কালজয়ী গল্প, যেটি কেউ কখনো বইয়ের পাতায় এখনো পড়েনি, কোনো লেখক বইতে লেখেননি। এমন অনেক পলান সরকার তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হতে থাকেন।
পলান সরকার ৯৮ বছর বয়সে ১ মার্চ দুপুরে আমাদের রেখে অন্য জগতে চলে যান। বার্ধক্য তাকে বইয়ের বোঝা বইতে দিলো না। যে বইয়ের বহরে তিনি মানুষকে বইয়ের প্রতি ভালোবাসার প্রবল বিশ্বাস শিখিয়েছেন। পৃথিবীর প্রাক্কালে হাজারও বই রচনা করা হবে, হাজারও পাঠক বই পড়বে। লেখকদের স্মরণ করবে। লেখক ছিলেন না, নেতা ছিলেন না, তবে বই পাঠ আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন পলান সরকার, এই ভেবে পৃথিবীর মানুষ তাকে স্মরণ করবে হাজার বছর বা তারও অধিক সময়। অজ্ঞতা, মূর্খতা আর পাপাচার যখন আমাদেরকে জাপটে ধরবে, ধ্রুপদি আকাশ ভেদ করে পলান সরকার আমাদের বিবেকদ্বারে এসে চমকপ্রদভাবে বলবেন, ‘হে মানবজাতি, তোমরা বই পড়ো। বই তোমাদের মুক্তি দিতে পারে।’


আরো সংবাদ



premium cement
তীব্র গরমের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার অন্যতম দায়ী : মির্জা আব্বাস সৈয়দপুরে জামায়াতের উদ্যোগে সালাতুল ইসতিসকার নামাজ আদায় জিম্বাবুয়ে সিরিজের শুরুতে না থাকার কারণ জানালেন সাকিব ঝালকাঠিতে গ্রাম আদালত কার্যক্রম পরিদর্শনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল চুয়াডাঙ্গায় বাতাসে আগুনের হল্কা : গলে যাচ্ছে সড়কের পিচ বৃষ্টির নামাজ আদায়ের নিয়ম আজও স্বর্ণের দাম ভরিতে ৬৩০ টাকা কমেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২৮ এপ্রিল খুলে দেয়ার প্রস্তুতি, ক্লাস চলবে শনিবারও মিরসরাইয়ে জুস খাইয়ে অজ্ঞান করে লুট, মূল হোতা গ্রেফতার বৃষ্টি কামনায় ঈশ্বরগঞ্জে জামায়াতে ইসলামীর ইসতিসকার নামাজ আদায় কুবিতে আল্টিমেটামের পর ভিসির কার্যালয়ে তালা ঝুলাল শিক্ষক সমিতি

সকল