২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ভাষা আন্দোলন জাদুঘর

বাংলা একাডেমি চত্বরে বর্ধমান হাউজের দ্বিতীয় তলায় চারটি কক্ষ নিয়ে সাজানো হয়েছে ভাষা আন্দোলন জাদুঘর -

চলছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। বাঙালির গর্বের মাস ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রাজপথে নামে ছাত্র-জনতা। শাসকগোষ্ঠীর বুলেটের আঘাতে রাজপথে তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মাতৃভাষা বাংলার জন্য প্রাণ দিয়ে শহীদ হন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত, শফিউলসহ নাম না জানা আরো অনেকে। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে যান মায়ের ভাষা বাংলাকে। ভাষার দিক দিয়ে বিবেচনা করতে গেলে পৃথিবীর যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলা ভাষা নিজের ইতিহাস-ঐতিহ্যে ব্যতিক্রম। তাই মাতৃভাষার প্রতি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ভালোবাসাও ভিন্ন।
ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর ২০১০ সালে বাংলা একাডেমি চত্বরে বর্ধমান হাউজের দ্বিতীয় তলায় ‘ভাষা আন্দোলন জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ভাষা-আন্দোলন জাদুঘর পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। দীর্ঘ দিন পর আমাদের দেশে ভাষা আন্দোলন জাদুঘর প্রতিষ্ঠা হলেও এখনো আমাদের দেশের অনেকেই জানেন না, ভাষা আন্দোলন জাদুঘর নামে একটি জাদুঘর রয়েছে। আর যারা জানছেন, তারা ভাষা আন্দোলন ও ভাষাশহীদদের সঠিক ইতিহাস জানার জন্য ছুটে যাচ্ছেন বাংলা একাডেমি বর্ধমান হাউজের দ্বিতীয় তলায়। চারটি কক্ষে সাজানো হয়েছে ভাষা আন্দোলন জাদুঘরটি। ভাষাশহীদদের ব্যবহার্য তেমন কিছু জাদুঘরটিতে স্থান না পেলেও ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই ভাষা জাদুঘর। জাদুঘরে যে ধরনের ইতিহাস সাক্ষী হয়ে রয়েছে, তা বাঙালি জাতিকে চেতনায় উদ্বুদ্ধ করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
ভাষা আন্দোলনের যাবতীয় তথ্য সংরক্ষিত রয়েছে এই জাদুঘরে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভাষাশহীদ জীবন সম্পর্কে ও কিভাবে দানা বেঁধেছিল ভাষা আন্দোলন তা জানার জন্য প্রতিদিনই ভিড় করছে সব বয়সের দর্শনার্থীরা।
এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা কিংবা আগামী প্রজন্মের জন্য ভাষা আন্দোলন জাদুঘর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ভাষা আন্দোলন জাদুঘরে সেই সময়ের আন্দোলনের ঐতিহাসিক আলোকচিত্র, সংবাদপত্র, স্মারকপত্র, ব্যঙ্গচিত্র, চিঠি, পাণ্ডুলিপি, পুস্তক-পুস্তিকার প্রচ্ছদ এবং ভাষাশহীদদের স্মারকবস্তু সংরক্ষরণ করা হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক পুস্তিকার প্রচ্ছদ, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্র-জনতার বিভিন্ন বিক্ষোভ মিছিলের আলোকচিত্র, মিছিলকে বাধা প্রদানে সারিবদ্ধ পুলিশবাহিনী, ধর্মঘট চলাকালে পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত ছাত্রনেতা শওকত আলীকে শেখ মুজিবুর রহমান রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ছবি, ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে বক্তৃতারত মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রী সংসদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্পর্কে প্রেস বিজ্ঞপ্তি, পত্রিকায় প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তুতির আলোকচিত্র, ভাষাশহীদদের আলোকচিত্র ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রথম শহীদ মিনার ও প্রভাতফেরির আলোকচিত্র। রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক দেশ বিভাগের আগেই শুরু। জাদুঘরের আলোকচিত্র, রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের সংরক্ষিত অংশ ও দৈনিক আজাদের পেপার কাটিং দেখলেই মাতৃভাষা আন্দোলনের বাস্তবতা বোঝা যায়। এ আলোকচিত্রগুলোতে একবার দৃষ্টি দিলেই আরো জানা যাবে দেশ বিভাগের পর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে এক প্রস্তাব উত্থাপনের বিষয়টি, কিন্তু তা স্ববিরোধী বক্তব্যে এড়িয়ে যায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ১৯৫২-এর ২৬ জানুয়ারি বাঙালি হয়েও নাজিমুদ্দিন জিন্নাহর বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে। এতে করে ১৯৫২-এর ৩০ জানুয়ারি বিকেলে বার লাইব্রেরি হলে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। সেই লাইব্রেরি হলের ছবি, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের স্মারকলিপির কপিও সযতেœ সংরক্ষিত আছে এই জাদুঘরে। জাদুঘরের সব আলোকচিত্র সাদাকালো হলেও ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য যথেষ্ট তা সহজেই অনুমান করা যায় এই জাদুঘরে প্রবেশের পর।
স্থান সঙ্কুলানের অভাবে অনেক আলোকচিত্র জাদুঘরে ঝোলানো যায়নি। অবশ্য ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রকাশিত স্মারক, তথ্যপ্রমাণভিত্তিক গ্রন্থ ও সঙ্কলনের প্রচ্ছদও সংরক্ষণ করা হয়েছে। তবে প্রচ্ছদ সংরক্ষণের তুলনায় বই সংগ্রহ করাই যৌক্তিক। তারপরও বাংলা একাডেমি ভাষা আন্দোলন জাদুঘরে ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৫৮ সালের আলোচিত ঘটনাসহ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের উল্লেখযোগ্য অংশ টানানো রয়েছে। মাহবুবুল আলম চৌধুরীর ভাষা আন্দোলনের প্রথম বিখ্যাত কবিতা ‘আমি কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতার পঙ্ক্তিমালাÑ ‘এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে/রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়/যেখানে আগুনের ফুলকির মতো/এখানে ওখানে জ্বলছে অসংখ্য রক্তের ছাপ/ সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি’ কবিতার হস্তলিখিত কপি সংরক্ষিত রয়েছে। ১৯৫২ সালে ২৬ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনার ভেঙে ফেলার প্রতিবাদে কবি আলাউদ্দিন আল আজাদের হস্তলেখা কবিতা ‘স্মৃতিস্তম্ভ’Ñ ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো/চার কোটি পরিবার/খাড়া রয়েছি তো! যে-ভিত কখনো কোনো রাজন্য/পারেনি ভাঙতে’
এবং ভাষা আন্দোলন নিয়ে গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা প্রথম গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’সহ আরো অনেক আলোকচিত্র স্থান পেয়েছে ভাষা আন্দোলন জাদুঘরে। ঢাকা কলেজের বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ফরহাদ হোসেন নূরু বইমেলা চলাকালীন ভাষা আন্দোলন জাদুঘরটি দেখতে আসেন। তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে, সেটি আমার জানা ছিল না। বইমেলায় ঘোরাঘুরি করার সময় হঠাৎ চোখে পড়ে জাদুঘরটির ফলক, আর ফলক না থাকলে জানা হতো না ভাষা জাদুঘরের কথা। যদি বাংলা একাডেমির সামনের সড়কে বড় করে জাদুঘরের সাইনবোর্ড লাগানো হয়, তাহলে অনেকেই জানতে পারবে।
মাত্র দু’জন কর্মচারী দিয়ে পুরো জাদুঘরটি তত্ত্বাবধান করা হয়। জাদুঘরের সার্বক্ষণিক দায়িত্বে আছেন আলোমতি গাইন নামে এক নারীকর্মী। তিনি জানান, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা চলাকালীন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ বইমেলার কিছু দর্শনার্থী ভাষা আন্দোলন জাদুঘর পরিদর্শনে আসেন। অন্য সময়ে প্রায় দর্শনার্থী শূন্য থাকে। ভাষা আন্দোলনের মতো একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। ভাষা আন্দোলনের ভাষাশহীদদের সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস জানার চেষ্টা না করি তাহলে তাদের আত্মত্যাগ বৃথা। পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন ভাষা আন্দোলন জাদুঘর থেকে। দর্শনার্থীদের পরিদর্শন শেষে দর্শনার্থীর নাম ও ঠিকানা লেখার জন্য একটি রেজিস্টার রয়েছে। কিন্তু রেজিস্টারে কোনো মন্তব্য কলাম না থাকায় দর্শনার্থীরা ভাষা আন্দোলন কিংবা জাদুঘর সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে পারছেন না।

খোলা থাকে : ভাষা আন্দোলন জাদুঘরটি রোববার থেকে বৃহস্পতিবার খোলা থাকে বেলা ১১টা থেকে ১২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত, মধ্যাহ্ন বিরতির পর বেলা ২টা থেকে বিকেল ৪টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত। ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলা চলাকালীন সাপ্তাহিক বন্ধ ছাড়াই প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে ৬টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত খোলা থাকে।

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement