২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
চারাগল্প

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

-


বিকেলে হল থেকে বের হয়ে চারটা টিউশনি করিয়ে তারপর রোজ সোয়া ৯টায় হলে ফেরে সৈকত। নিলয়, সাগর আর সৈকত একই রুমে থাকে। সেদিন সৈকত হল থেকে যাওয়ার সময় বলল রাতে সে খাবে না। তার খাবার বন্ধ রাখতে। সৈকত বলে ফিরতে আজ অনেক দেরি হবে। আজ অনেক কাজ। নিলয় বলল, ভাইয়া রাতে আমরা খিচুড়ি পাকাব আপনি কিন্তু বাইরে থেকে খেয়ে আসবেন না। রুমে এসে খাবেন। নিলয় তোমার সাইকেলটা নিয়ে গেলাম, হ্যাঁ!
না থাক হেঁটেই যাই। বলে বের হয়ে গেল সৈকত। সৈকতের বাবা গ্রামের স্কুল মাস্টার। লেখাপড়ায় সৈকত চমক লাগানো প্লেয়ার। ডিপার্টমেন্টে ফাস্ট হওয়া ছাত্র। মাস্টার্স শেষ হতে আর মাত্র মাস তিনেক বাকি। বড় উদার মনের মানুষ। চারটা টিউশনির তিনটাই হলো বিনে পয়সার। গরিব মেধাবী ছাত্রদের পড়ায় কিন্তু টাকা নেয় না সৈকত। সাগর সৈকতের ইয়ারমেট আর নিলয় দুই বছরের ছোট। সৈকত পাঞ্জাবি পড়তে খুব পছন্দ করে। সেদিনও পরনে একটি সাদা পাঞ্জাবি ছিল। অন্য দিন সৈকত খুব সহজেই চলে যায় টিউশনিতে, কিন্তু সেদিন কেমন যেন ভার্সিটির মাঠ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল আর বারবার ফিরে হলের দিকে তাকাচ্ছিল। রাত ১১টা বেজে গেল, সৈকত রুমে আসেনি। সাগর আর নিলয় খিচুড়ি খেয়ে সৈকতের খাবারের থালাটা সৈকতের টেবিলের উপর রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল দু’জনে। সাগরের কানে কেমন যেন লোকজনের আনাগোনা আর ছোট ছোট কথার শব্দ ভেসে আসছিল। হঠাৎ মনে পড়ল সৈকতের কথা। লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে আলো জ্বালিয়ে দেখল সৈকত আসেনি। যেমন খাবার তেমনি আছে। জানালা খুলে একটু কান খাড়া করেই সাগর পাগলের মতো নিলয়ের বেডের পাশে গিয়ে নিলয়কে আচমকা ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে উঠাল। নিলয়! নিলয়, এই নিলয়! সৈকত এখনো রুমে ফিরেনি। বাইরে আবার মনে হচ্ছে কেমন যেন লোকজনের কথা শোনা যাচ্ছে। চল তো একটু বাইরে যাই। দেখি রহমত চাচার ওখানে আছে কি না। সাগর আর নিলয় চোখ মুছতে মুছতে রহমত চাচার দোকানের সামনে গেল। ওখানে আছে অনেক মানুষ, কিন্তু সৈকত নেই। সবাই খুব ব্যস্ত। কেউ রং দিয়ে দেয়ালে, চুন দিয়ে গাছে, কেউ এদিক ওদিক থেকে দৌড়ে এসে বড় বড় সাদা, লাল, নীল, হলুদ রঙের কাগজ দিয়ে আবার দৌড়ে চলে যাচ্ছে। নিলয়ের মাথায় কিছু ঢুকছে না। হা করে চোখ মুছছে আর চেয়ে চেয়ে দেখছে। সাগর একজনের কাছে শুনল, ভাই; সৈকতকে দেখেছেন। একজন বলল সৈকত আছে। হ্যাঁ সৈকত একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত আছে। সাগর কণ্ঠ শুনে চিনতে পারল। আরে পলাশ ভাই, কী ব্যাপার আমাকে একটু বুঝিয়ে বলেন না। পলাশ সাগর আর নিলয়কে নিয়ে চুপি চুপি বলল, সব প্লানের কথা। সাগর আগেই শুনেছে এমন কিছু হবে। কিন্তু সেটা যে এত শিগগিরই হবে সেটা মাথায় আসেনি আগে। পলাশ জানাল সৈকতের অবস্থান। পলাশ অনুরোধ করল সেখানে সাগর আর নিলয়কে না যেতে। রাস্তায় কড়া টহল চলছে। মাঝে মধ্যে শকুনেরা জিপে করে আপ-ডাউন করছে। সাগর সৈকতের খুব অন্তরের অন্তর। সাগর নিলয়কে বলল, নিলয় তুমি রুমে যাও। আমি সৈকতের সাথে দেখা করেই চলে আসব। নিলয় জানাল, ভাই আমিও যাবো আপনার সাথে। সাগর না চাইলেও নাছোড়বান্দা নিলয়। দু’জনে ঠিক সেই ঠিকানায় গিয়ে পৌঁছাল। গলির ভেতরে ঢুকতেই কয়েকজন ঘিরে ধরল। পলাশ ভাইয়ের বলা সঙ্কেত বলতেই ওদের নিয়ে গেল একটি ঘরের ভেতরে। সৈকত ওদের দেখেই উঠে এগিয়ে এলো। বুকে টেনে নিলো সাগর আর নিলয়কে। তোরা এত রাতে এখানে কিভাবে এলি রে। আরে পাগল রাস্তাঘাটের কী অবস্থা জানিস। ওরা দেখলে কি হতো জানিস। বলে বুকের সাথে জোরে আকড়ে ধরল। তোদের কে বলেছে আমি এখানে আছি।
সাগর বলল, কানে লোকজনের কেমন যেন কথা ভেসে আসছিল। উঠে দেখি তুই ফিরিসনি। টেবিলের ওপর তোর খাবার ঠিক সেভাবেই আছে। ভালো লাগছিল না। তাই রহমত চাচার দোকানে গেলাম। ওখানে পলাশ ভাইয়ের কাছ থেকে এইখানের ঠিকানা পেলাম। রুম ভরা শুধু কাগজ আর কাগজ তৈরি হচ্ছে ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড, পোস্টার, সবাই ব্যস্ত।
নিলয় ভাই আপনি রাতে খেয়েছেন কি?
সৈকত ক্ষিধে নেই তো খাবো কিভাবে।
Ñভাই তা হলে আমরা হলে গিয়ে খিচুড়ির প্লেটটা এনে দিয়ে যাই। আপনি কোন সময় ফিরবেন রুমে?
দেশের অবস্থা খুব খারাপ। একবার শকুনদের নজরে পড়লেই আর নিস্তার নেই কারো।
Ñআমার ক্ষিধে নেই সোনাভাই। তোরা চলে যা, আমি কাল হয়তো ফিরব রুমে। পর তিন ভাই খিচুড়ি পাকিয়ে সাথে মুরগি দিয়ে কবজি ডুবিয়ে খাবো ইনশা আল্লাহ।
সাগরের আর বুঝতে বাকি নেই। বুঝে ফেলেছে বড় ধরনের প্ল্যান করেছে সবাই। কাল কিছু একটা হবেই। সৈকতকে বলতেও পারছে না যে, তুই রুমে চল। এ সবের দরকার নেই। আবার সৈকতকে এখানে রেখে রুমে যেতেও একদম মন চাচ্ছে না। চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে সাগরের।
Ñসৈকত সাগরের চোখের দিকে তাকিয়ে আবার বুকে টেনে নিয়ে গভীর হাসি দিয়ে বলল, যা রুমে যা সাগর। বেশি রাত হলে বেশি সমস্যা হবে। টেনশন করিস না। শোন, রাতে যদি কেউ রুমের দরজা খুলতে বলে, খুলবি না। হায়েনারা হলেও রেড দিতে পারে। যা যা, বেরিয়ে পড়।
সাগর অপলক দৃষ্টিতে সৈকতের দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বের হলো আর বলল, সাবধানে থাকিস সৈকত বলে হু হু করে কেঁদে দিলো। সৈকত একটু এগিয়ে এসে দরজায় মাথা বাড়িয়ে তাকিয়েছিল।
সকালবেলা চারদিকে মিছিল আর মিছিল। সারারাত একটুও চোখ বন্ধ হয়নি দু’জনের। দরজা খুলে বারান্দায় এসেই দেখতে পেলো মিছিলের সামনে সৈকত। রক্তে সাড়া জাগানো সেøাগান শুনে নিজেকে আর থামিয়ে রাখতে পারল না সাগর। দোতলা থেকে লাফ দিয়ে দৌড়ে মিছিলের পেছনে যুক্ত হলো। মিছিল ভার্সিটি ঘুরে বের হতেই নিলয়ও ঢুকে পড়ল মিছিলে। বিশাল বড় মিছিল। সৈকত একদম সামনে। মিছিলের ভেতর থেকে বুঝতেই পারছিল না সাগর, মিছিল কোন দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ মিছিল আরো বেগবান হলো। সেøাগানের জোর আর বেড়ে গেল। হঠাৎ গ্যাড গ্যাড করে কয়েকবার শব্দ হলো। দম করে থেমে গেল মানুষের স্রোতটা। লুটিয়ে পড়ল কিছু আগুনের গোলার থেকেও তেজি নক্ষত্র। রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাজপথ। লোকজন কমে যাওয়ার পর তাদের নিস্তেজ দেহটা পাওয়া গেল। তাদের মধ্যে সৈকতকে দেখতে পেলো না সাগর। নিলয়ের কথা তো মনেই নেই সাগরের। রুমে ফিরছিল সাগর পেছন থেকে নিলয় ডাক দিয়ে বলল, ভাই, সৈকত ভাই আসছে না?
সাগর ভাঙা গলায় বলল, না ওখানে নেই। ভাই হয়তো কোথাও গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। রুমে ঢুকে বেডের ওপর বসে সাগর ভাবছে গা ঢাকা দেয়া ছেলে তো সৈকত না। তাহলে সৈকত গেলো কোথায়। শকুনেরা নির্বিচারে গুলি করে নিজেদের বর্বর চিত্রকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য কিছু লাশ সাথে সাথে গায়েব করে দিয়েছিল। একদিন দু’দিন তিনদিন করে এভাবে এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলো। সৈকতের কোনো খবর মিলল না।
শালিখা, মাগুরা


আরো সংবাদ



premium cement