১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ওরা শহীদ মিনারে যাবে

চারাগল্প
-


এই সাতসকালে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসে সাজসজ্জায় পুরোপুরি মনোযোগী তানিশা খান। পরনে সাদা শাড়ি, কপালে নীল টিপ, খোলা চুল...সব মিলিয়ে তানিশা খানকে অপূর্ব লাগছে। সকালে ঘর ঝাড়– দিতে এসে বেগম সাহেবার এমন আয়োজন দেখে লিপি প্রশ্ন করে, ‘সেকি, এই সকাল বেলা আবার কই যাবেন?’ ঠোঁটে লিপস্টিক মাখতে মাখতে তানিশা খান বললেন, ‘শহীদ মিনারে যাবো। আজ ২১ ফেব্রুয়ারি।’
তানিশা খানের দুই ছেলে অয়ন আর অনিক পাঞ্জাবি পরে মায়ের কাছে চলে এসেছে। শহীদ মিনারে যাবে বলে ওদের আনন্দের সীমা নেই। এমন দৃশ্য দেখে লিপিরও খুব ইচ্ছে হলো ওদের সাথে শহীদ মিনারে যাওয়ার। বেগম সাহেবার কাছে এই আবদার রাখতে তিনি ক্ষেপে উঠে বললেন, ‘না হবে না। তুই গেলে নাস্তা বানাবে কে? মনে রাখিস, তুই এই বাসার কাজের মেয়ে।’ মনটাই খারাপ হয়ে গেল লিপির। আজ দুই বছর ধরে এই বাড়িতে কাজ করে সে। এই দুই বছরে তানিশা খানের কত যে কটু বাক্য শুনতে হয়েছে তাকে। সেসব ভাবলে আজকাল বড় কান্না আসে লিপির।
তানিশা খান দুই ছেলেকে নিয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় লিপিকে বললেন, ‘আমরা তিন ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসবো। তুই সব রেডি করে রাখিস।’ লিপি মলিন কণ্ঠে বলল, ‘ঠিক আছে।’
ওরা চলে যাওয়ার পর লিপি সংসারের কাজে মনোযোগী হতেই হঠাৎ তার কানে ভেসে এলো বাইরের মাইকের শব্দ। মাইকে বাজছে, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...।’ আজ ভাষাদিবস। লিপি ভাষাদিবস সম্পর্কে একটু একুট জানে। গ্রামে প্রাইমারিতে যেত সে একসময়। শাজাহান স্যার বলতেন, ১৯৫২ সালে নাকি বাংলা ভাষার জন্য এ দেশে সংগ্রাম হয়েছে। সেই সংগ্রামে প্রাণ দিয়েছে সালাম, রফিক, সফিক, বরকত ও জব্বারসহ অনেকে। তাই ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে দেশব্যাপী ভাষাদিবস পালন করা হয়। আজ সেই ভাষাদিবস। গ্রামে থাকার সময়ে লিপি একবার ২১ ফেব্রুয়ারির সকালে শহীদ মিনারে ফুল নিয়ে গেছে বান্ধবীদের সাথে। ক্লাস ফোর পাসের পর সংসারের অভাব-অনটনের কাছে বিলীন হয়ে যায় লিপির শিক্ষাজীবন।
সময় তাকে নিয়ে এসেছে এই শহরে। পরিস্থিতি তাকে বানিয়েছে তানিশা খানের বাসার কাজের মেয়ে। কিন্তু গ্রামকে বড্ড মনে পড়ে লিপির। মা-বাবাকে ও বড় আপাকে মনে পড়ে। বাড়ির এই মানুষগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য তানিশা খান লিপিকে তার ব্যবহৃত পুরনো মোবাইলটা দিয়েছেন। সেখানে সবার নম্বর সেইভ করে রেখেছে সে। আরো একজনের নম্বরও সেইভ করে রেখেছে। মাহবুবের নম্বর, যে লিপিকে খুব পছন্দ করে। তানিশা খান বাসায় না থাকলে লিপি চুপি চুপি মাহবুবকে ফোন করে খোঁজখবর নেয়। গত কয়েক দিন ধরে মাহবুবের নম্বর বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কি যে হলো কে জানে!

২.
এখন সকাল ৯টা। নাশতা বানানো শেষ করে লিপি টিভিটা চালু করেছে। ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সব চ্যানেলে লাভই হচ্ছে। বিভিন্ন ব্যক্তিরা ভাষা দিবসের তাৎপর্য নিয়ে টকশোতে মেতেছেন। চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ লিপির চোখে পড়ে তার বেগম সাহেবাকে। ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে একুশের প্রোগ্রাম। তানিশা খান সাংবাদিকদের মাইক্রোফোনের সামনে ভাষা দিবসের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিচ্ছেন। লিপির বিশ্বাস হচ্ছে না তার বেগম সাহেবাকে টিভিতে দেখাচ্ছে। সে কল দেয় বেগম সাহেবাকে। ওপার থেকে লাইন কেটে দিচ্ছেন তানিশা খান।
ক্যামেরার সামনে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা শেষ করে তানিশা খান কল দেয় লিপিকে। লিপি রিসিভ করেই উৎকণ্ঠে বলল, ‘আপনাকে টিভিতে দেখলাম। কী সুন্দর লেগেছে।’ ওপার থেকে তানিশা খান রেগে বলেন, ‘তুই টিভি ছেড়েছিস কেন? এত বড় সাহস তোর! দাঁড়া, আমি এসে তোর বারোটা বাজাবো হারামজাদী কোথাকার।’ বলেই লাইন কেটে দেন তানিশা খান।
মনটাই খারাপ হয়ে গেল লিপির। মনে মনে সে ভাবে, ’৫২র ভাষা আন্দোলনের মতো এ দেশে কাজের মেয়েদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধ হওয়া দরকার। লিপি সে যুদ্ধে সবার আগে অংশ নেবে।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী


আরো সংবাদ



premium cement