১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অমর একুশে গ্রন্থমেলা

-

চলছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। ফেব্রুয়ারি এলেই বাঙালি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে ভাষাশহীদদের কথা। ভাষাশহীদদের স্মরণে ফেব্রুয়ারিতে মাসজুড়ে চলে বইমেলা। ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে বাঙালির প্রাণের এই মেলা। তাই ফেব্রুয়ারি এলেই বইয়ের জন্য ছুটে আসেন অগণিত পাঠক-ভক্ত-অনুরাগী। বাংলা একাডেমির আয়োজনে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে মাসব্যাপী শুরু হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বাঙালি বইমেলার জন্য একটি বছর অধীর অপেক্ষায় থাকেন আর সেই অপেক্ষার প্রহর গুনার সেই কাক্সিক্ষত ক্ষণ হাজির হলে উচ্ছ্বসিত হন লেখক, পাঠক, প্রকাশক, ক্রেতাদর্শনার্থীরা। প্রিয় লেখকের প্রিয় নতুন সব বইয়ের জন্য সবই ছুটে আসেন বইমেলায়। স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সমাগম ঘটে এই মেলায়। এমনকি শিশু কিশোরদের খোরাক জোগাচ্ছে নতুন নতুন সব বই। তাই বাবা-মায়ের হাত ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মেলায় আসছে শিশু-কিশোরেরা। বই কেনার পাশাপাশি চিত্তবিনোদনের মধ্য দিয়ে সময় কাটছে তাদের।
বইমেলাতে দেখা মেলে কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের। ফলে প্রিয় মানুষের সাক্ষাতের জন্য বইমেলা উপযুক্ত জায়গা। এক কথায় বইমেলাকে মিলনমেলা বললেও ভুল হবে না। লেখকদের পাশাপাশি পেশাজীবী বিভিন্ন সংগঠনের মানুষজনও মেলায় আসেন মাতৃভাষার টানে। বাংলা সাহিত্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কারণে নানা ব্যস্ততার মাঝেও একবারের জন্য হলেও বইমেলায় ছুটে আসেন তারা। তাই প্রতিটি স্টল কিংবা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আড্ডারত অবস্থায় দেখা যায়। এর বাইরেও প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, আলোচক, চিকিৎসক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, রাজনৈতিক ব্যক্তি, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী, খেলোয়াড়সহ অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয় বইমেলা। এমনকি বাংলা ভাষাভাষী মানুষ সুদূর প্রবাস থেকে মেলায় আসেন ভালোবাসার টানে। প্রতি বছরের মতো এবারো সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার শিশুপ্রহর ঘোষণা করা হয়। শিশুপ্রহরে থাকছে মজার মজার সব খেলা। শিশুদের বইপড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে এ উদ্যোগ নেয় বাংলা একাডেমি। বইমেলায় শিশুদের আকর্ষণীয় বিষয়ে পরিণত হয় সিসিমপুর।
এবারের বইমেলায় ৪৯৯টি প্রতিষ্ঠানের ৭৭০টি ইউনিট এবং বাংলা একাডেমিসহ ২৪টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ২৪টি প্যাভিলিয়ন নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছে। লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে ১৮০টি লিটল ম্যাগকে ১৫৫টি স্টল দেয়া হয়েছে। একক ছোট প্রকাশনা সংস্থা এবং ব্যক্তি উদ্যোগে যারা বই প্রকাশ করেছেন, তাদের বই বিক্রি ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্টলে। এবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান গত বছরের চেয়ে বেশি জায়গা নিয়ে সাজানো হয়েছে। যার ফলে এবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ক্রেতা-দর্শনার্থীরা হাঁটাচলার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা পাবেন। মেলার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের নামকরণ করা হয়েছে ভাষাশহীদ বরকতের নামে। আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণকে চারটি চত্বরে ভাগ করে উৎসর্গ করা হয়েছে ভাষাশহীদ সালাম, রফিক, জব্বার ও শফিউলের নামে। ভাষাশহীদদের নামে উৎসর্গকৃত এবারের মেলায় দ্ইু প্রাঙ্গণের পাঁচটি চত্বরের প্রতিটি সাজসজ্জায় রয়েছে পৃথক রঙের ব্যবহার। এবার দর্শনার্থীদের বসার জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের লেকের সাথে সংযুক্ত করে বসার সুব্যবস্থা করা হয়েছে। ক্রেতা-দর্শনার্থীরা বই কেনার পাশাপাশি বিনোদনের মধ্য দিয়ে সময় কাটাতে পারবেন। গতবারের তুলনায় এবার মুসল্লিদের জন্য নামাজের সুব্যবস্থা রয়েছে। আয়োজকরা দাবি করেছেন, এবারের মেলার বিন্যাস যেকোনো বইমেলার তুলনায় অনেক ভালো।
গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমি এবং মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করছে। এবারের মেলায় প্রথমবারের মতো সংযুক্ত হয়েছে লেখক বলছি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মেলার পূর্বদিকে অবস্থিত প্রতিদিন নতুন নতুন লেখকরা নানা বিষয়ে কথা বলতে পারবেন। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে রয়েছে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন মঞ্চ। এখানে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন দেশের প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক। এ বছর গল্প-কবিতা-উপস্যাস ও ছোটদের বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি চলমান রাজনীতির বই বিক্রি ভালো বলে জানান বিক্রেতারা।
মেলার দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার জন্য পুরো এরিয়াকে সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছে। সেই সাথে মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনের জন্য বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাব, আনসার, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থা নিয়োজিত রয়েছে। আয়োজকরা মনে করছেন, এবার বই বিক্রি ভালো হবে। বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে বিক্রি সন্তোষজনক থাকলেও অন্য দিনগুলোতে বিক্রি একেবারেই কম। অন্য দিকে, নামীদামি প্রকাশনাগুলোতে বিক্রি ভালো হলেও অপেক্ষাকৃত নতুন প্রকাশন ও স্টলে বিক্রি কম। তারা প্যাভিলিয়নগুলোতে ভিড় করছে এমনটাই দেখা গেছে। তবে বেশির ভাগ বিক্রেতা জানান, প্রতি বছরই মেলার প্রথম দিকে বিক্রি কম হলেও শেষের দিনগুলোতে বিক্রি বাড়বে বলে জানান।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য আত্মত্যাগের যে করুণ ঘটনা ঘটে, সেই স্মৃতিকে অম্লান রাখতেই এ মাসে আয়োজিত এই বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’।
এই মেলার ইতিহাস স্বাধীন বাংলাদেশের মতোই প্রাচীন। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। এই ৩২টি বই ছিল চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশী শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। এই বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সালে পর্যন্ত তিনি একাই বইমেলা চালিয়ে যান নিজ উদ্যোগে। ১৯৭৬ সালে অন্যরা অনুপ্রাণিত হন বইমেলার প্রতি। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে মেলার সাথে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি; এই সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সালে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। সেই ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলা কালানুক্রমে বাঙালির সবচেয়ে স্বনামধন্য বইমেলায় পরিণত হয়েছে। এই মেলায় সরকারেরও বহু রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, যেমনÑ বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, বাংলাদেশ প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর ইত্যাদি তাদের স্টল নিয়ে মেলায় অংশগ্রহণ করে। এ ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানও অংশ নেয়। সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে। আর শুক্র ও শনিবার সকাল ১০ থেকে বিরতিহীন চলবে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত।


আরো সংবাদ



premium cement