১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কে লিখেছে গল্প : চারাগল্প

-

সজীবের ভীষণ মন খারাপ। গত দুই মাস ধরে বিভিন্ন প্রকাশকের দুয়ারে দুয়ারে দৌড়েও কোনো লাভ হয়নি। কোনো প্রকাশকই এবার তার বই করতে রাজি নন। ‘আপনার পরিচিতি নেই, লোকে বই কিনবে না, অপরিচিত লেখকের বই প্রকাশ করে প্রতিবারের মতো সর্বনাশ ডেকে আনব না।, আপনার বই যে চলবে তার গ্যারান্টি কি’Ñএই জাতীয় বাণী শুনিয়ে প্রকাশকেরা সজীবকে বিদায় জানায়। ফলে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। এবারের উপন্যাসটা যদি প্রকাশ করা যায়, তবে সজীবের উপন্যাসের সংখ্যা দাঁড়াবে মোট তিনটিতে। গত দুই বইমেলায় তার দুটি বই বের হয়েছে। কিন্তু পাঠকমহলে সাড়া ফেলতে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে বই দুটি। লেখায় যথেষ্ট কোয়ালিটি থাকার পরও সজীবের পরিচিতির অভাবে বই আলোচনায় আসতে পারেনি।
লেখালেখির প্রতি এই যে তীব্র টান সজীবের, এটা সে পেয়েছে মূলতো হিমেলের কাছে। হিমেল সজীবের কাছের বন্ধু। স্কুলজীবনে সজীব প্রায়ই দেখতো হিমেল পত্রিকায় তার প্রকাশিত গল্প এনে স্কুলজুড়ে হইচই ফেলে দিচ্ছে। নামকরা পেপারে হিমেলের গল্প এসেছে, এটা জেনে সবাই হতবাক হয়ে যেত। সেখান থেকেই লেখালেখির প্রতি সজীবের আগ্রহ। পত্রিকায় তারও গল্প ছাপা হবে, এই স্বপ্নে তার চোখ রঙিন হতো।
একসময়ে লেখালেখি শুরু করে সজীব। হিমেলের মতো সেও পত্রিকায় লেখা পাঠাতে থাকে এবং সেগুলো ছাপা হতে থাকে। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখে অবিশ্বাস লাগত সজীবের। সেই নেশা এখনো রয়ে গেছে। এখন সজীবের বয়স ২৭। দীর্ঘদিন ধরে এই লেখালেখির সাথে সে জড়িত।
অন্য দিকে, হিমেলেরও লেখালেখির প্রতি ভালোবাসা থাকার পরও সে আর এদিকে সময় দিতে পারছে না। কারণ হিমেল পেশায় এখন অভিনেতা। নতুন মুখ সন্ধানের প্রতিযোগিতায় সে উইনার। তাই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে সে হয়ে উঠেছে টিভি নাটকের জনপ্রিয় অভিনেতা। বলা যায় অভিনয় তাকে লেখালেখি থেকে সরিয়ে এনেছে।
টিভি সাক্ষাতে প্রায়ই হিমেল তার লেখালেখির প্রসঙ্গ টেনে আনে। অভিনয় তার লেখালেখি বন্ধ করেছে, এই ঘটনা হিমেলের অন্যান্য ভক্তের মতো জানেন প্রকাশক মাহবুব রহমান। নাদিয়া প্রকাশনীর মতো বিশাল প্রকাশনার কর্ণধার তিনি। ইতোমধ্যে তিনি অনেক তারকার বই প্রকাশ করেছেন।
সকালে হিমেলের ফোনে মাহবুব রহমানের কল। হিমেলকে জানান তিনি হিমেলের বই প্রকাশ করতে চান, যদি পাণ্ডুলিপি রেডি থাকে। যদিও পাণ্ডুলিপি রেডি নেই, তবুও বই প্রকাশের লোভ হিমেলকে হঠাৎ পেয়ে বসল। প্রকাশককে পাণ্ডুলিপি দেবে বলে কথাও দেয়।
হিমেল কল দেয় সজীবকে। সজীব জানায় তার কাছে উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি আছে।
Ñদোহাই বন্ধু, ওই পাণ্ডুলিপি আমাকে দিয়ে দে, বইমেলায় তোর ওই উপন্যাস আমার নামে বের হবে।
Ñনা না। তা কী করে হয়!
Ñপ্লিজ বন্ধু।
হিমেলের তীব্র অনুরোধ আর না করতে পারেনি সজীব। যদিও নিজের লেখা উপন্যাস আরেকজনের নামে বের হবে, এটা মন থেকে চাইছে না সে।

২.
আজ বইমেলার তৃতীয় দিন। ফেসবুকে ঘোষণা, অনেক বিজ্ঞাপন, খবরের কাগজে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে অবশেষে আজ নাদিয়া প্রকাশনী থেকে বের হচ্ছে জনপ্রিয় অভিনেতা হিমেলের প্রথম উপন্যাসÑরাত্রী শেষের নির্জনতা। মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে হিমেলের সাথে সজীবও এসেছে। প্রথম উপন্যাসের অভিজ্ঞতা জানিয়ে মিডিয়া সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে একে একে সাক্ষাৎকার দিচ্ছে হিমেল। পাশে দাঁড়িয়ে আছে হিমেলের ভক্তের ঢল, যাদের হাতে হিমেলের উপন্যাস। তারা ফেসবুকে ঘোষণা দেখে বইমেলায় এসেছে প্রিয় তারকার উপন্যাস কিনতে।
হিমেল একে একে ভক্তদের অটোগ্রাফ লিখে দিচ্ছে। সাথে ছবিও তুলছে। প্রথম দিনেই বইটি এত বিক্রি হবে, ভাবতেই পারেননি প্রকাশক মাহবুব রহমান। তিনি হাসি মুখে হিমেলের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে সজীব। প্রথম দিনেই বইটি এত চলছে দেখে সে মনে মনে ভাবছেÑ এই বইয়ের সত্যিকারের লেখকের নামে প্রকাশ হলে বইটি কখনোই এভাবে বিক্রি হতো না। কিন্তু সুপরিচিত হিমেলের নামে বইটি বের হয়েছে বলে সবাই এত আগ্রহ নিয়ে কিনছে। আসলে ওইসব বই কেনা ভক্তরা কতটুকু পাঠক!
৩.
সাত দিন পরের ঘটনা। সজীব হিমেলের সাথে উত্তরায় এসেছে শুটিং দেখতে। হিমেল ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে সংলাপ দিচ্ছে। সজীবের হাতে হিমেলের ফোন। ফোনে কল এলো প্রকাশক মাহবুব রহমানের। সজীব রিসিভ করল। ওপার থেকে প্রকাশকের উচ্ছ্বাস গলাÑ ‘জনাব হিমেল, সুখবর। আপনার বই সব বিক্রি শেষ। আমরা দ্বিতীয় মুদ্রণের ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ সজীব গলাটা হিমেলের মতো করে বললÑ‘আচ্ছা, আমার বন্ধু সজীবও লিখে। ওর বই প্রকাশ করে দেবেন?’ প্রকাশক তৎক্ষণাৎ বললেনÑ ‘না না, আমরা অখ্যাতদের বই করি না। দেখেন না আপনি, তারকা বলে আপনার বই মানুষ কিভাবে কিনছে! আমরা বেশির ভাগ প্রকাশক ওই সুযোগটাই খুঁজি, যেহেতু এটা আমাদের বাণিজ্য শিল্প।’ সজীব চুপ করে প্রকাশকের কথাগুলো শুনে যায়।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী


আরো সংবাদ



premium cement