১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চারাগল্প : মাফলার

-

মাসুমের শ্বাসকষ্ট আগের তুলনায় বেড়েছে। ওষুধেও এখন আর কাজ হচ্ছে না। শ্বাসকষ্টের তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে সে হাঁপাতে হাঁপাতে আমার কাছে এসে বললÑ ‘দাদা, এই নে ৫২০ টাকা। এবারের শীতে আমার জন্য একটি মাফলার কিনে আনবি।’ টাকা হাতে নিয়ে বলি, ‘এত টাকা কোথায় পেলি ভাই?’ বুকের গভীর থেকে উঠে আসা ভারী কাশ দিতে দিতে বলল, ‘কাল মিজান মামা এসেছেন। ওষুধ কিনতে আমাকে ৫০০ টাকা দিয়ে গেছেন। ২০ টাকা আমার কাছে আগেই ছিল। আমি ওষুধ কিনব না। মাফলার কিনব।’
মাসুমের কথা শুনে বুঝলাম একটি দামি মাফলারের বড় শখ ওর। সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘এখনো যে শীত জেঁকে বসেনি ভাই। বাজারে ভালো মানের মাফলার এখনো আসেনি। শীত পড়লে আসবে। তখন কিনব।’ মাসুম হেসে বলল, ‘আচ্ছা’। আমি মাসুমের দেয়া ৫২০ টাকা মানিব্যাগে ভরে রাখি।
মাসুম আমার ছোট ভাই। বয়স এবার ওর পনেরো। ছোটবেলা থেকে শ্বাসকষ্ট আর হাঁপানিতে ভুগছে। মাসুমের অসুখের মাত্রা এতই প্রখর যে, ওর নাকি মাঝে মধ্যে মনে হয় ও আর বেশি দিন বাঁচবে না।

২.
বিকেল বেলায় মায়ের চিৎকারে সারা বাড়ি কেঁপে উঠল। উচ্চস্বরে মায়ের হাঁকডাকÑ ‘আমার মাসুম ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কথা কয় না কেন রে...।’ দৌড়ে গিয়ে দেখি ঘটনা সত্যি। মাসুম নিথর। ওর সারা শরীর ঠাণ্ডা। কথা কয় না।
বাড়িতে ডাক্তার ডাকা হলো। পরীক্ষা করে ডাক্তার নিশ্চিত হলেন, মাসুম আর নেই। নিরস কণ্ঠে ডাক্তার যখন বললেন, ‘ছেলেটা বেঁচে নেই’, সারা বাড়িতে তখন শোকের মাতম। মায়ের আহাজারি বাড়তে থাকে।
সাদা কাপড়ে ঢেকে দেয়া হলো মাসুমকে। ওর দু’চোখ বন্ধ। মাসুমের আর শ্বাসকষ্ট হবে না। এসব ভাবতে ভাবতে আমি ডালিম তলায় গিয়ে অঘোরে কাঁদছি। এনামুল চাচা এসে বললেন, ‘শুধু কাঁদলে হবে! দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করতে হবে না?’
৩.
আমি এখন বাজারের দিদার ক্লথ স্টোরে। মাসুমের জন্য কাফনের কাপড় কিনতে এসেছি। দোকানদার কাফনের যাবতীয় জিনিসপত্র ব্যাগে ভরে দাম চাইলেন, ‘মোট ৫২০ টাকা এসেছে’।
৫২০ টাকা! বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। মানিব্যাগ খুলে দেখি এক কোণে ৫০০ টাকার একটি নোটের ভেতর ২০ টাকার নোট পড়ে আছে। এই টাকা কয়েক দিন আগে মাসুম দিয়েছে। ওর জন্য মাফলার কিনতে। সেই ৫২০ টাকা দিয়ে দিলাম কাফনের মূল্য পরিশোধে।
৪.
আমি বাড়ি যাচ্ছি। আমার হাতে মাসুমের জন্য কেনা কাফনের ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর থেকে আতর আর ন্যাপথিনের কড়া গন্ধ ভেসে আসছে। এসবের দাম ৫২০ টাকা।
জীবনের কিছু কিছু অংশ এক অদ্ভুত সমীকরণ। যে ৫২০ টাকা দিয়ে মাসুমের জন্য দামি একটি মাফলার কেনার কথা ছিল, সেই ৫২০ টাকা দিয়ে আজ ওর জন্য কাফন কিনে বাড়ি যাচ্ছি। মাসুমের জন্য আর কোনো দিন মাফলার কেনা হবে না। এটা ভাবতেই আমার বুকের ভেতরে বেদনার এক বিশাল পাহাড় ভাঙতে শুরু করল।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী


আরো সংবাদ



premium cement