২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মানবতার কল্যাণে স্বপ্নযাত্রী

-

চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা থানার মালঘর গ্রামের ছেলে কামাল হোসেন। বাবা মাস্টার আবুল নাছের। মা নূরনাহার বেগম। হাতেখড়ি মালঘর প্রাইমারি ইশকুলে। অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকে কর্মরত। রাঙ্গামাটি শাখায়। সাহসী ও উদ্যমী একদল তরুণ নিয়ে কামাল হোসেন গড়ে তুলেছেন ‘স্বপ্নযাত্রী ফাউন্ডেশন’। স্বপ্নযাত্রী কামাল হোসেনের স্বপ্ন ও ভালোবাসার ফসল। স্বপ্নযাত্রীর গল্প শুনি কামাল হোসেনের মুখে।
মালঘরে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি, সমাজে শ্রেণিবৈষম্য, ধনী-গরিব ভেদাভেদ, অবহেলা অনাদরে বেঁচে থাকা মানুষ আর শিক্ষার অভাব। এসব আমাকে পীড়া দিত। মানুষের কষ্ট আমি সহ্য করতে পারতাম না। ছেলেবেলা বাসায় ভিক্ষুক এলে মা আমাকে দিয়ে চাল অথবা টাকা দিতেন। তাদের পানিও খাওয়াতাম। তাদের জন্য মায়া হতো। বয়স বাড়ছে। ইশকুল-কলেজ পড়ছি। এদিক-সেদিক বেড়াচ্ছি। সবদিকে, সবখানেই সাধারণরা অবহেলিত। গরিব-অসহায়রা বঞ্চিত। শ্রেণিবৈষম্য। পথশিশুরা অপরাধে ভয়াবহ রকম ঝুঁকছে। সব মিলিয়ে ভাবলাম কী করা যায়! কিভাবে সমাজের মানুষের মাঝে পরিবর্তন আনা যায়! অসহায় এতিম-গরিবের পাশে দাঁড়ানো যায়! সংগঠন করার চিন্তা মাথায় এলো। বন্ধুদের সাথে শেয়ার করি। সাড়া দেয়, উৎসাহিত করে। অনেকে বলল, জলদি শুরু কর। মিটিং ডাকলাম। বাজারের কোচিং সেন্টারে বসলাম। ৩০ জন উপস্থিত হলো। কার্যক্রম শেয়ার করলাম। সায় দিলো হাত নেড়ে। সেখানেই নাম নির্বাচন করতে বললাম। প্রত্যেকে পাঁচটি করে নাম দিলো। বললাম, স্বপ্ন দেখছি সমাজ নিয়ে। মানুষ নিয়ে। ‘স্বপ্নযাত্রা’ নাম কেমন হয়? বলল, ভালো। হুসাইন বলল, স্বপ্নযাত্রী হোক। সেদিন থেকে আমরা স্বপ্নযাত্রী। ২০১৬ সালের পয়লা এপ্রিল ছিল দিনটি। তখন কিছু বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছি। লোক কমে যায়। কাজ শুরু করি ১১ জন মিলে। ধীরে ধীরে স্বপ্নযাত্রী বড় হয়। সদস্য বাড়ে। এখন কার্যনির্বাহী আছে ২৭ জন। সাধারণ সদস্য ৭১ জন। স্বেচ্ছাসেবক ২০০ জন। ৬০ জন ফুড ব্যাংকে। মানুষ এখন স্বপ্নযাত্রীকে ভালোবাসে।
ব্লাড ডোনেশন
সংগঠনের যাত্রা ব্লাড নির্ণয় কর্মসূচি দিয়ে। আমরা ১১ জন ৫০০ টাকা করে চাঁদা দেই। আয়োজনে আরেকটি সংগঠনের সহযোগিতা নিই। মালঘর বাজারে ক্যাম্পিং করি, বিনামূল্যে। ব্যাপক সাড়া পড়ে। প্রচুর মানুষের ভিড় জমে। বৃদ্ধ, যুবক, নারী, কিশোর এমনকি লাঠি ভর করেও লোকেরা এলেন। গ্রামের সবাই খুশি। আমাদের দোয়া করলেন। ভালো লাগল আমাদের। বিপুল অনুপ্রাণিত হলাম। এ পর্যন্ত চারটি বিনামূল্যে রক্ত নির্ণয় কর্মসূচি সম্পন্ন করেছি। আড়াই হাজার মানুষের রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করেছি। সবাইকে রক্তদানে উৎসাহিত করেছি। ভালো দিক বলেছি। মানুষ এখন রক্ত দেয়। স্বপ্নযাত্রীর সদস্যরা কয়েক দফায় রক্ত দিয়েছে, দিচ্ছে। আমাদের কাছে লিস্ট আছে। মানুষ এখন সহজেই রক্ত পায়।
শিক্ষা
গরিব, মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ দিচ্ছি। ২০১৭ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ১০০ শিক্ষার্থীকে খাতা, কলম, ব্যাগ দিয়েছি। ২০১৮তে দিয়েছি প্রায় ২০০ জনকে। ন্যূনতম এক বছর ব্যবহার করতে পারবে। ৫০ জন প্রতিবন্ধীকে ব্যাগ, ইউনিফর্ম, বই, খাতা ও কলম দিয়েছি। পড়াশোনায় উৎসাহিত, নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা, মানবসেবায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন ইশকুলে রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করি। আসর জমাই। আয়োজনে থাকে রচনা প্রতিযোগিতা, চিত্রাঙ্কন, সুন্দর হাতের লেখা, ইতিহাসচর্চা। বিজয়ীদের পুরস্কার দিই। শিক্ষার্থীরা আনন্দিত হয়। আমাদের ধন্যবাদ জানায়।
রাঙ্গামাটি পাহাড়ধস
আমি তখন রাঙ্গামাটি নিউমার্কেট ইসলামী ব্যাংকে চাকরিরত। পাহাড়ধসের খবর পেয়ে তড়িঘড়ি সেখানে যাই। সাথে একজন বন্ধু। ঘরবাড়ি ভেঙে টুকরো হয়ে আছে। মানুষ মারা গেছে অনেক। মানুষের হাহাকারে ভারী পাহাড়ি অঞ্চলের আকাশ-বাতাস। বিধ্বস্ত পাড়ার দৃশ্য হৃদয়কে অস্থির করে তুলে। জীবনে দেখা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা। করুণ এ দৃশ্য দেখছি আর হৃদয়ে ব্যথা বাড়ছে। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছাই চট্টগ্রাম উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ে। সেখানে অনেক মানুষ। উ™£ান্ত। উদ্বাস্তু। সেখানে সন্ধ্যার আজান পড়েছে। মানুষ ইফতার করছে। মনে পড়ল, আমিও তো রোজা।
রমজান মাস ছিল তখন। তারা কেউ ইফতার করছে না। কিছুই নেই তাদের কাছে। তখনই বাজারে যাই। আপেল, মুড়ি, পানি নিয়ে আসি। ইফতার করে। তাদের বেশি প্রয়োজনীয় জিনিসের কথা জিজ্ঞেস করে সংগঠনের বন্ধুদের ফোন দিই। তারা কালেকশনে নেমে পড়ে। ব্যাপক সাড়া মেলে। মানুষ আগ্রহী হয়ে টাকা দিয়েছে। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, আলু, তেল, শাড়ি, লুঙ্গি, গেঞ্জির ব্যবস্থা করেছি তাদের জন্য।
মালঘর নিভৃতপল্লী। রাস্তায় আলো নেই। সন্ধ্যা হলে অন্ধকার জেঁকে বসে রাস্তায়। মানুষের চলাচলে কষ্ট হয়। বন্ধুরা মিলে মিটার মালিকদের সাথে আলোচনা করে লাইট লাগিয়ে দিই। রাস্তার মোড়ে, মানুষের বসার জায়গায় আর যেখানে ঝোপঝাড় বেশি। ৩০টি লাইট লাগিয়েছি। মালঘর এখন আলোকিত। মানুষ স্বস্তি নিয়ে হাঁটে।
স্বপ্নযাত্রী ফুড ব্যাংক
আমি আর এক বন্ধু সকালের নাশতা করছিলাম হোটেলে। জানালার ফাঁকে দেখি, কয়েকজন বৃদ্ধ ফুটপাথে বসে আছেন কোদাল হাতে। মন বলল, তারা এখনো খাননি। সে মুহূর্তে তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে গেল ময়লা জামার দুই পথশিশু। কড়াইয়ের রুটির দিকে তাকিয়েই হাঁটছিল। মনে কষ্ট পেলাম। ইচ্ছা হলো, তাদের ভোজন করাতে। স্বপ্নযাত্রীদের সাথে আলাপ করি। ওমর ফারুক ফুড ব্যাংকের ধারণা দিলেন। তাকে মূল দায়িত্বে রেখে শুরু করলাম ফুড ব্যাংক কর্মসূচি। ২০১৭ সালের ৯ নভেম্বর ফুড ব্যাংকের যাত্রা। নিজেরা প্রথমে টাকা দিয়েছি। প্রত্যেক সূচনা কাজে স্বপ্নযাত্রীরা পয়সা খরচ করে। শুরুটা ৫০ জন এতিম অভুক্তকে নিয়ে। পরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের অতিরিক্ত খাবার সংগ্রহ করে অসহায়দের মধ্যে বিলাতে থাকি। স্বপ্নযাত্রীর নম্বর দিয়ে কার্ড করলাম। ফেস্টুন সাঁটলাম দেয়ালে দেয়ালে। লিখে দিলাম, অনুষ্ঠানে বেঁচে যাওয়া খাবার আমাদের দিন, আমরা অসহায় এতিম অভুক্তদের মধ্যে পৌঁছাব। অল্পদিনে ফুড ব্যাংক সাড়া জাগায়। ফোন আসতে থাকে। সদস্যরা খাবার এনে অভুক্তদের দেয়। কেউ রাত ১টায় ফোন করে বললেন, খাবার আছে। আমরা রাতের আঁধারে ছুটে যাই। রাতেই খাবার বিতরণ করি। স্টেশন, ফুটপাথে, রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকা মানুষকে ডেকে তুলি। না খেয়ে ঘুমিয়ে থাকলে খাবার খেতে দিই। তারা বিশ^াস করতে পারে না, তাদের ঘুম থেকে জাগিয়ে কেউ খাবার দিচ্ছে। তারা বলে, বাজান, মানুষ আমাদের তাড়িয়ে দেয়। নাক সিঁটকায়। সারাদিন ঘুরেও কখনো খাবার পাই না। আর তোমরা আমাদের খাওয়াচ্ছ। আল্লাহ তোমাদের মঙ্গল করুন ।
স্বপ্নযাত্রী বিদ্যাপীঠ-১
রাঙ্গামাটি শান্তিনগর গ্রাম। বস্তি। বসতি পাঁচ হাজার মানুষের। শিক্ষিত মানুষের বড় অভাব। ইশকুল নেই গ্রামে। দূরের গ্রামে আছে। শিশুরা দূরের ইশকুলে যায় না। আমরা ঘর ভাড়া নিই। প্রি-প্রাইমারি ইশকুল চালু করি। ২০১৮-এর প্রথম জানুয়ারি থেকে ক্লাস শুরু হয়। নাম রাখি, স্বপ্নযাত্রী বিদ্যাপীঠ-১। শিক্ষার্থী ৫০ জন। একজন ম্যাডাম। শিক্ষার্থীরা দুই ব্যাচে পড়ে। ২৫ জন করে। সকাল ৮টা থেকে ১০টা। ১০টা থেকে ১২টা। এখানে পড়তে টাকা লাগে না। আমরা চাই, শিক্ষিত সমাজ গড়ে উঠুক। তারা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন হোক। কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করব অচিরেই। যেন তারা বেকার না থাকে।
মহানুভবতার দেয়াল
খেয়াল করলাম, বাসায় পুরনো কাপড় নষ্ট হচ্ছে অনেকের। নতুন কাপড় ছোট হয়ে গেছে। তারা এগুলো পরছেন না। আবার অনেকের কাপড় প্রয়োজন। শরীর ঢাকার কাপড় পর্যন্ত নেই কারো। সমন্বয় করার চিন্তা করলাম। গড়ে তুললাম মহানুভবতার দেয়াল। দেয়ালে লাগিয়ে দিলাম হেঙ্গার। ডান পাশে লিখলাম, তোমার যা প্রয়োজন নেই, এখানে রেখে যাও। বাম পাশে লিখলাম, তোমার যা প্রয়োজন আছে, এখান থেকে নিয়ে যাও। মানুষ কাপড় দিয়ে যাচ্ছে। কেউ এসে নিয়ে যাচ্ছে। মহানুভবতার একটি দেয়াল আছে এখন। মুজাদ্দেদে আলফেসানি বিদ্যালয়ে। দায়িত্বে আছেন ইশকুল শিক্ষক। স্বপ্নযাত্রীর সদস্য। বেশ জনপ্রিয় দেয়াল। মানুষ ভালোবেসেছে দেয়ালকে। এত সুন্দর আইডিয়াতে আমারও মুগ্ধ।
বন্ধুরা আমাকে অনেক সহযোগিতা করে। আমাদের উপদেষ্টা আছেন চৌধুরী আনোয়ার ভাই। তিনি যথেষ্ট ভালো মানুষ। আড়ালে থেকে কাজ করেন। স্বপ্নযাত্রীর ডাকে তিনি তৎপর। নাইম, ইমন প্রথম থেকেই আমাকে হেল্প করছে। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই মোহাম্মদ ফরিদ, এহসানুল হক, মোহাম্মদ হোসাইন, এস এম শহীদুল হক, গিয়াস উদ্দিন, নাজিম উদ্দিন, মোহাম্মদ হেলাল, কাজী ইমন, নাঈম হোসাইনরা আষ্টেপৃষ্ঠে আছেন। তারা আমার সহযোদ্ধা। পরিবার থেকে আমাকে কখনো কিছু বলেনি। তারা উৎসাহিত করেছে বারবার। তারাই আমার চেতনার বাতিঘর।
এবার স্বপ্নযাত্রী ফাউন্ডেশনের পক্ষে ‘জয় বাংলা ইয়ুথ’ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। আমাদের ভালো লেগেছে। অনুপ্রাণিত হয়েছি। পুরস্কার পাবো বা কেউ কাজের মূল্যায়ন করবে, এ কথা কল্পনা করে সংগঠন করিনি। তবে পুরস্কার আমাদের দায়িত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement
আওয়ামী লীগকে ‘ভারতীয় পণ্য’ বললেন গয়েশ্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে দাগনভুঞার যুবক নিহত কাশ্মিরে ট্যাক্সি খাদে পড়ে নিহত ১০ অবশেষে অধিনায়কের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছল পাকিস্তান জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থাকে আবার অর্থায়ন শুরু করবে জাপান শেখ হাসিনার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি বিএনপিকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে : ওবায়দুল কাদের রাশিয়া সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টে ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৩৬ সেনা সদস্য দৌলতদিয়া ঘাটে পন্টুন থেকে নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু অ্যানেসথেসিয়ার পুরনো ওষুধ বাতিল করে কেন নতুনের জন্য বিজ্ঞপ্তি! বাইডেনের মেয়াদে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতির কোনো আশা নেই : রুশ রাষ্ট্রদূত

সকল