২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

একাত্তরের অপমান : চারাগল্প

-

জীবনের মধ্য বয়সে এসেও মিনু রহমান শারীরিকভাবে বেশ সুস্থ। বিশাল এই বাড়িতে মিনু রহমান একাই থাকেন। পুরোপুরি একা বললে ভুল হবে। তিন বছর ধরে মিনু রহমানের সাথে এই বাড়িতে রিমাও থাকে। রিমা মিনু রহমানের মামাতো ভাইয়ের মেয়ে। ভার্সিটিতে পড়ে। বাড়ি থেকে ভার্সিটির পথ বেশ দূরে বলে, মিনু রহমান নিজেই রিমাকে এখানে এনে রেখেছেন। এ বাড়িতে রিমার উপস্থিতির মধ্য দিয়ে দূর হলো মিনু রহমানের দীর্ঘদিনের একাকিত্ব।
মিনু রহমান একাকী মানুষ। মা-বাবার মৃত্যুর পর সেই একাকিত্ব দ্বিগুণ বাড়ল। নিয়তি তাকে সংসারের দিকে পা বাড়াতে দেয়নি। ফলে স্বামী-সংসার-সন্তানের মুখ আর তার দেখা হয়ে উঠেনি। অথচ নিজাম উদ্দিনের সাথে তার সংসার বাঁধার কথাও ছিল। দুই পরিবারের মতামতের ওপর ভিত্তি করে তাদের বিয়ের কথাও পাকা হয়েছে। ১৯৭১ সালের কথা সেটি। মিনু রহমান আর নিজাম উদ্দিনের যখন বিয়ের বাজনা বাজবার সময় খুব কাছে চলে এসেছে, হঠাৎ করেই তখন দেশে পাকিস্তানি হায়েনাদের আক্রমণ। শহরের সীমানা ছেড়ে গ্রামেও ওইসব হায়েনারা ঢুকে পড়েছে। চারদিকে খুন, বোমা, রক্তপাতের ভয়ে গ্রামবাংলায় যখন এক অস্থির সময় চলছে, তখন নিজাম উদ্দিন ও তার বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলেন যুদ্ধে যাওয়ার। হবু বরের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান মিনু রহমান। দেশকে স্বাধীন করার অঙ্গীকার নিয়ে দলবলসহ যুদ্ধে গেলেন নিজাম উদ্দিন। ততদিনে মিনু রহমানদের গ্রামেও পাকিস্তানিদের হামলা। হামলা করতে এসে তাদের কুনজর পড়ে মিনু রহমানের রূপ লাবণ্যতার দিকে। ওরা টেনেহিঁচড়ে মিনু রহমানকে নিয়ে যায় তাদের ক্যাম্পে। সেখানে দিনের পর দিন ধর্ষিত হতে থাকে মিনু রহমান। এক সন্ধ্যায় তিনি পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসেন।
৯ মাসের সেই যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হয় ১৬ ডিসেম্বর। বিজয়ের আনন্দ নিয়ে গ্রামে ফিরে আসেন নিজাম উদ্দিন। হবু বউয়ের ধর্ষিত হওয়ার গল্প শোনে নিজাম উদ্দিন মিনু রহমানকে বিয়ে করতে দ্বিমত পোষণ করেন। একজন ধর্ষিতাকে বিয়ে করে সমাজে মানসম্মান নষ্ট করার কথা ভাবতেই পারেন না নিজাম উদ্দিন। ফলে বিভিন্ন কৌশলে তিনি মিনু রহমানের জীবন থেকে সরে দাঁড়ান। বিয়ে করেন তার দুঃসম্পর্কের এক মামাতো বোনকে। হবু বরের এই প্রতারণায় চরম আঘাত পেলেন মিনু রহমান। ফলে আর বিয়ে করে সংসার সাজানোর কথা ভাবতেই পারেননি। চোখের জল মুছে কুমারী জীবন বেছে নিয়েছেন। ক্রমেই হয়ে উঠেন নিঃসঙ্গ জীবনের বাসিন্দা।
২.
রিমা সেজেগুজে ফুফুর সামনে এসে বসল। মিনু রহমান বললেন, ‘কোথাও যাবি নাকি?’ মিষ্টি হেসে রিমার জবাব, ‘যাবো। আজ আমার বান্ধবী সুলতানার বার্থ ডে।’ মিনু রহমান রিমার হাতে এক হাজার টাকার একটি নোট ভরে দিলেন বান্ধবীর জন্য গিফট কিনতে।
৩.
রাতে সুলতানার বাসা থেকে জন্মদিনের আয়োজন শেষ করে ফিরে এলো রিমা। ওখানে কী কী আয়োজন হয়েছে, সব ফুফুর কাছে ব্যাখ্যা করছে সে। মোবাইল ক্যামেরায় ধারণকৃত ছবিগুলো একে একে ফুফুকে দেখাচ্ছে। মিনু রহমান রিমার মোবাইলে ছবিগুলো দেখছেন। হঠাৎ একটি ছবিতে একজন মাঝ বয়সের পুরুষকে দেখে বুকটা ধক করে উঠল। মানুষটাকে চেনা চেনা লাগছে। মিনু রহমান ভালো করে তাকিয়ে দেখেন মানুষটা আর কেউ নয়, স্বয়ং নিজাম উদ্দিন। কিন্তু নিজাম উদ্দিন এখানে কেন! রিমাকে ডেকে জানতে চান লোকটি সম্পর্কে। রিমা বলে, ‘ইনি নিজাম আঙ্কেল। সুলতানার বাবা। আমাকে খুব আদর করেন।’ মিনু রহমানের চোখ ভিজে আসে। মোবাইলখানা রিমার হাতে দিয়ে তিনি আঁচলে চোখ মুছলেন।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী


আরো সংবাদ



premium cement