২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল শিল্প

-

অভিজ্ঞ শিল্পীর গভীর মনোযোগে, বয়সী হাতে নিখুঁতভাবে তৈরি হচ্ছে ভাস্কর্য। মোমের তৈরি এ মডেলের ওপর প্রথমে মাটির প্রলেপ দেয়, যখন শক্ত আকার ধারণ করে তখন দেয়া হয় মোমের প্রলেপ। এরপর মোম গলে ভেতরটা ফাঁপা হয় আর সেখানে গলিত কাঁসা ঢেলে দেয়া হয়। আবারো চলে ঠুকঠাক হাতের ছোঁয়ার নিপুণ কারুকাজ। এরপর ঠাণ্ডা হলে পলিশ করা হয় ‘এন্টিক লুক’ আনার জন্য। এভাবেই তৈরি হয়ে গেল কাঁসা-পিতলের ভাস্কর্য। যার চাহিদা ও সুনাম দেশ ছাপিয়ে বিশ্বব্যাপী। ধামরাইয়ে কাঁসা-পিতল শিল্পের এ যাত্রা শুরু হয় পাল বংশের আমলে। হাজার বছরের বেশি সময়ের ইতিহাসের সাক্ষী ধামরাইয়ের ঐতিহ্যবাহী এই কাঁসা-পিতল শিল্প। বর্তমানে বিশ্ববাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও সঠিক প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বাজার পাচ্ছে না এই শিল্প। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে হারিয়ে যেতে বসা এই শিল্প রক্ষায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণের দাবি সংশ্লিষ্টদের।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে কাঁসা-পিতলের ব্যবহার। একসময় আমাদের দেশে পিতলের জিনিসপত্র ব্যবহারের খুব প্রচলন ছিল। বিশেষ করে রান্নাঘরের তৈজসপত্র ও ব্যবহার্য সামগ্রীর ক্ষেত্রে পিতলের থালা, বাটি, গ্লাস, রান্নার হাঁড়ি ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো। সাধারণত জমিদারবাড়ি ও অভিজাত পরিবারগুলোতে বেশি দেখা যেত পিতলের তৈজসপত্র। তামা কাঁসার জিনিসপত্র ব্যবহারকে অভিজাতের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো।
ঢাকা জেলার বৃহত্তম উপজেলা ধামরাই এলাকা কাঁসা-পিতলের জন্য বিখ্যাত ছিল। ওই সময় শুধু বাংলাদেশ নয়, দেশের বাইরেও ছিল এর প্রচুর চাহিদা। এ ছাড়া বিদেশী পর্যটকেরা একসময় কাঁসা-পিতলের মধ্যে কারুকাজখচিত বিভিন্ন দেবদেবী ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি জিনিসপত্রগুলো নিয়ে যেত। কিন্তু এই কাঁসা-পিতল শিল্পের ঐতিহ্য আজ বিভিন্ন সমস্যায় দিনে দিনে হারিয়ে যেতে বসেছে। এ ঐতিহ্যবাহী শিল্পের সাথে জড়িত শিল্পী ও ব্যবসায়ীরা আজ অভাব অনটনে দিন কাটাচ্ছে। তাদের দেখারও কেউ নেই। বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে আজ কাঁসা-পিতল শিল্পে জড়িতরা বিভিন্ন পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছে। এই কারুশিল্পী ও ব্যবসায়ীদের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কখনোই কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কেউ।
বাংলাদেশে কিংবা অবিভক্ত বাংলায় কাঁসা-পিতলের প্রচলন কখন, কিভাবে শুরু হয়েছিল তা নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। প্রতœতাত্ত্বিকদের মতে, এটি প্রাচীন সভ্যতার আমলে শুরু, যখন ব্রোঞ্জশিল্প ছিল। আবার অনেকেই এ শিল্পকে মহাস্থানগড়কেন্দ্রিক সভ্যতার সাথে সম্পৃক্ত বলে মনে করেন। ১৫৭৬-১৭৫৭ সালে মোগল আমলে উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে কাঁসা-পিতলের ব্যবহার শুরু হয়। তখন এসব ধাতু দিয়ে ঢাল, তলোয়ার, তীর-ধনুক ইত্যাদি যুদ্ধ সরঞ্জাম তৈরি করা হতো। ব্রিটিশ শাসন আমলেও এ শিল্পের প্রসার ঘটে এবং বাংলার ঘরে ঘরে এর ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সে সময় ঢাকার ধামরাই, শিমুলিয়া ছাড়াও টাঙ্গাইলের কাগমারী, জামালপুরের ইসলামপুর, বগুড়ার শিববাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে কারখানা গড়ে উঠতে শুরু করে।
কালের বিবর্তনে পিতল সামগ্রীর ব্যবহারের মাত্রা দিন দিন কমে গেলেও শৌখিন মানুষের কাছে এর চাহিদা রয়ে গেছে বৈকি! অন্দরসজ্জার উপকরণ হিসেবেও ইদানীং ঘরে শোভা পাচ্ছে পিতলের সামগ্রী। এসবের মধ্যে রয়েছে নানা রকম শোপিস, ওয়াল ম্যাট, ফুলের টব, বিভিন্ন ধরনের গ্লাস, থালা, বাটি, কাজলদানি, চামচ, হুক্কা, কলস, ঘণ্টা, গামলা, চামচ, বালতি, ডেগ, কড়াই প্রদীপ, বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, সঙ্গীত সাধনার যন্ত্র, খেলনা, আয়নার ফ্রেম ইত্যাদি তৈরি করতেন। তখনকার দিনে এসব জিনিসের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও।
এ ব্যাপারে কথা হয় ধামরাই মেটাল ক্র্যাপ্টসের স্বত্বাধিকারী সুকান্ত বণিকের সাথে। প্রায় ২০০ বছর ধরে তার পূর্বপুরুষেরা এ পেশার সাথে জড়িত। তিনি বলেন, ধামরাই উপজেলা সদরেই নোটা, ঘটি, হাঁড়ি-পাতিল, থালা, গ্লাস, বদনি ও বিভিন্ন শোপিচ, দেবদেবী ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি জিনিসপত্র তৈরির জন্য স্বাধীনতার আগেও প্রায় ৩০-৪০টি কারখানা ছিল। বর্তমানে এ কারখানা সংখ্যা ৪-৫টি মতো। সময়ের সাথে পাপ্লা দিয়ে প্লাস্টিক, লোহা ও স্টিলের তৈরি এসব জিনিসপত্র হওয়ায় কাঁসা-পিতল কেনায় বেশ ভাটা পড়েছে। তিনি বলেন, কাঁসা-পিতলের তৈরি জিনিসপত্র একবার কিনলে তা ২০-৩০ বছরের বেশি সময় ব্যবহার করা যায়। শুধু তা-ই নয়, যে দামে কেনা হতো ব্যবহারের পর তার চেয়েও বেশি দামে বিক্রি করা যেত। এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, আগে এসব জিনিসপত্র রফতানির ক্ষেত্রে তেমন একটা বেগ পেতে হতো না। বর্তমানে রফতানি করতে গেলে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।
ধামরাই মেটাল ক্র্যাপ্টসে কর্মরত নিমাই পাল (৪৫) নামের এক শ্রমিক। তিনি বলেন, আগে বাপ-দাদার সাথে প্রতিমা তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিলেন। বর্তমানে কাঁসা-পিতলের তৈরির সাথে তিনি এখানে ২৩ বছর ধরে কর্মরত আছেন। তিনি প্রতিমা ও বিভিন্ন দেবদেবীর এবং জীবজন্তুর প্রতিকৃতির কর্মকার। এখানে তিনি প্রতিদিন গড়ে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা উপার্জন করতে পারেন। কথা হয় ৫৫ বছর বয়সী কাঁসা-পিতলের ব্যবসায়ী আনিসুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, তার বাপ-দাদার পেশা ধরেই ৩০ বছর ধামরাই বাজারে ব্যবসা করে আসছেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পরও এ ব্যবসা ছিল বেশ জমজমাট। এ বাজারেই ছিল অনেক ব্যবসায়ী। বর্তমানে আছে হাতেগোনা কয়েকজন। এই ব্যবসায়ী বলেন, বর্তমানে শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মেয়ের বিয়েতে উপহার হিসেবে কাঁসা-পিতলের তৈরি কিছু জিনিসপত্র কেনা হয়। তা ছাড়া সচরাচর কেউ এসব কেনে না। তাই ব্যবসায় পড়েছে ভাটা। শিল্পকর্ম ব্যবসায়ী অরুণ বণিক জানান, আমরা কাঁসা-পিতলের থালার মধ্যে নকশা করে বিক্রি করলে ২০০-২৫০০ টাকা দাম পাওয়া যায়। এতে লাভ থাকে মোটে ২০০-৩০০ টাকা।
ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল কারিগর রাশেদা মোশাররফ বলেন, দেশের ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে বাঁচাতে হলে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে এবং সহজ শর্তে করতে হবে ব্যাংক ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা। তিনি আরো বলেন, আমাদের এসব জিনিস তৈরিতে প্রচুর টাকা প্রয়োজন হয়। আবার দেখা যায়, ব্যবসা কখনো ভালো আবার কখনো খারাপ হয়। অথচ ব্যাংক চড়া সুদে লোন দিতে আগ্রহী হয়। আবার ব্যাংক লোন নিলে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। রাশেদা বলেন, এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার যদি সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ সুদে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করে তাহলে অনেক ভালো হবে। তিনি বলেন, গুলশান হামলার ঘটনার পর থেকে বিদেশী ক্রেতা একেবারেই কমে গেছে। তামা কাঁসা শিল্পে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করতে পারলে এবং তাদের তৈরি দ্রব্যসামগ্রী বিদেশে রফতানি করার ব্যবস্থা করলে এ শিল্প থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

 


আরো সংবাদ



premium cement
জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থাকে আবার অর্থায়ন শুরু করবে জাপান শেখ হাসিনার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি বিএনপিকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে : ওবায়দুল কাদের রাশিয়া সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টে ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৩৬ সেনা সদস্য দৌলতদিয়া ঘাটে পন্টুন থেকে নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু অ্যানেসথেসিয়ার পুরনো ওষুধ বাতিল করে কেন নতুনের জন্য বিজ্ঞপ্তি! বাইডেনের মেয়াদে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতির কোনো আশা নেই : রুশ রাষ্ট্রদূত ডিএমপির অভিযানে গ্রেফতার ৪০ নিউইয়র্কে মঙ্গোলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ফ্ল্যাট জব্দ করবে যুক্তরাষ্ট্র! টাঙ্গাইলে লরি-কাভার্ডভ্যান সংঘর্ষে নিহত ১ জিম্বাবুয়ে সিরিজে অনিশ্চিত সৌম্য

সকল