১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বন্ধুত্বের ১৫ বছর পেরিয়ে

-

২০০৩ সালে বৃত্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল অপূর্বর সাথে। কমলালেবুর মতো চেহারা, খানিকটা লম্বা হাসিমাখা মুখ। পাশাপাশি সিট পড়েছিল আমাদের। আমাদের সামনের সিটে বসেছিল অমিতাভ। আর আমাদের ঠিক পেছনের বেঞ্চেই ছিল অভিজিতের সিট। অপূর্ব অভিজিত ও অমিতাভ, ওরা সবাই একই প্রাইমারিতে পড়ত। প্রথমে অপূর্বর সাথে পরিচয় হলেও ওদের কথাবার্তায় তাল মেলাতে মেলাতে ওদের সাথেও পরিচিত হয়ে গেলাম। ২০০৪ সালের জানুয়ারির ১ তারিখে শুরু হলো আমার মাধ্যমিক জীবন। প্রথম দিনে স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়েছি আমরা দুইজন। আমি আর আমার সামনে একজন। মকমলের লাল কালারের একটা কোর্ট পরা। লম্বা চুল আর পকেটে দু’টি দামি কলম গেঁথে রাখা। দেখেই চিনে ফেললাম ও সেই অমিতাভ। বৃত্তি পরীক্ষার অমিতাভ। ক্লাসে গিয়ে পেয়ে গেলাম অপূর্ব ও অভিজিতকেও। নতুন স্কুলের নতুন পরিবেশে সব নতুন মুখের মধ্যে কিঞ্চিৎ পরিচিত কাউকে পাওয়ার থেকে আনন্দের আর কী হতে পারে। এভাবে দু-এক বছর করতে করতে আমরা এসএসসি পরীক্ষার্থী। ততক্ষণে আমাদের চারজনের বন্ধুত্ব অনেক গভীরে গিয়ে ঠেকেছে। আমরা তিনজন ছিলাম কমার্সে আর অমিতাভ ছিল সায়েন্সে। ও আমাদের ডেবিট-ক্রেডিট বলে ক্ষেপাত আর আমরা ওকে ফোড়া কাটা চানসি ডাক্তার বলে ক্ষেপাতাম। একদম সামনের স্যারের সোজাসুজি বেঞ্চটি ছিল আমাদের দখলে। ক্লাসের ভালো ছাত্রদের নামের তালিকায় আমরা তখন অনেক ওপরে। আমরা চারজনে টিফিনে পাশা খেলতাম। কখনো বা কলম খেলতাম। আবার কখনো বা বাইরে গিয়ে ভলিবল খেলতাম। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে অমিতাভ চলে গেল অন্য কলেজে। আর আমার তিনজনে ভর্তি হলাম একই কলেজে। একসাথে কলেজে যাওয়া, সকাল-বিকেল একই সাথে প্রাইভেট পড়া। হাজারও মধুর স্মৃতির জন্ম দিত নিজেদের অজান্তে। তখনো মোবাইলের রাজত্ব ততটা আসেনি। অমিতাভের ফোন ছিল। আমাদের কারো ছিল না। অপূর্বর শান্তু কাকার ফোনে কথা হতো অপূর্বর সাথে। অমিতাভ বলত, কবে আসবে বাড়ি। আমরা সাইকেলে করে তিনজনে এগোতে যেতাম অমিতাভকে। অমিতাভ আমাদের সাথে কলেজেও যেত মাঝে মধ্যে। এরপর এইচএসসি পাস করে চারজন চলে গেলাম চায়ের জগতে। অমিতাভ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। অভিজিত বাবার টাকার শ্রাদ্ধ করতে ভর্তি হলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। অন্য দিকে আমি আর অপূর্ব ভর্তি হলাম যশোরে। দু’জনে যশোরে একই কলেজে ভর্তি হলেও দু’জনের ছিল দুই জগৎ। অপূর্ব নিজেকে টিকিয়ে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল টিউশনিতে। আর আমি একবার বাড়ি আরেকবার যশোর করা শুরু করলাম। কোথাও আমার ভালো লাগত না। জীবনের ছন্দপতন হলো আমার। আমি কেমন যেন হয়ে পড়লাম। জড়িয়ে পড়লাম লেখালেখির সাথে। এরপর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সবাই বাড়ি গিয়ে আবার এক জায়গায় হতাম। আড্ডা দিতাম চুটিয়ে। যে যত বড়ই হয় না কেন, আমরা চারজন এক জায়গায় হলে শুরু হয়ে যেত কত যে শিশুসুলভ আচরণ। কত মজা করতাম। সারা বিকেল আড্ডা দিতাম চারজনে। কখনো গলা ছেড়ে গান ধরতাম। আবার কখনো অমিতাভের ফোনে গান চালিয়ে চারজনে পাগলের মতো নাচানাচি করতাম।
সময় বড়ই জৌলুশ জিনিস। চোখের পলকের থেকেও দ্রুত রূপ পাল্টায়। আজ আমরা প্রত্যেকে অনেক অনেক দূরে। নিজেদের পজিসন আর নিজ নিজ আত্মমর্যাদবোধ আমাদের মধ্যে উঁচু প্রাচীর গড়ে ফেলেছে। এক সময় যে মান-অভিমান ছিল কচুপাতার পানির মতো কোনো রকম নাড়া দিতেই নুয়ে পড়ত। সেই মান-অভিমান আজ অনেক বেশি। কেউ কাউকেই ছাড় দিতে রাজি নয়। পিছুটান আর অহমিকা আমাদের হৃদয় কঠিন করে তুলেছে। তবুও কিছু সম্পর্ক এমন হয়, যেখানে সব প্রতিবন্ধকতা ব্যর্থ হয়।
নিজের পছন্দে বিয়ে করে আমি এখন এক বিবাহিত বেকার। কুলাঙ্গারের মতো বাবা-মায়ের ঘাড়ে বসে আছি। অমিতাভ তো নিজের পছন্দে বিয়া করায় পরিবার থেকে বিতাড়িত হয়ে দুর্বিষহ জীবন পার করছে। অভিজিত, সে তো প্রেমিকা নিয়েই ব্যস্ত। আর অপূর্ব? ওর দিন কাটে এ বাসা থেকে ও বাসায় ঘুরতে ঘুরতে। ১০-১২টা টিউশনি তার। খাওয়ারও সময় নেই।
শালিখা, মাগুরা


আরো সংবাদ



premium cement