২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জয়পুরের পথে পথে : ভ্রমণ

-

ভারতের জয়পুর স্টেশনে আমরা তিনজন যখন নামলাম, তখন রাত প্রায় ১টা। এত রাতে সাধারণত হোটেলে রুম পাওয়া যায় না। তার ওপর এটা পর্যটন এলাকা। হোটেলের আশায় স্টেশনের বাইরে এলাম। এক ট্যাক্সিওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম এ ব্যাপারে। তিনি এখানের স্থানীয়। পুরো এলাকা তার জানাশোনা। বললেন, একটু দূরেই অল্প ভাড়ায় একটা মুসলিম মুসাফিরখানা আছে। সেখানে রুম মিলতে পারে। তার ট্যাক্সিতে চড়েই রওনা হলাম সেখানে।
ট্যাক্সি থামল মুসাফিরখানার সামনে। ভাড়া চুকিয়ে রাতের খাবারটা খেয়ে নিলাম। মুসাফিরখানায় আইডি দেখিয়ে একটা রুম ভাড়া করলাম। অল্প দামে খুব সুন্দর রুম মিলল। গোসল সেরে শুয়ে পড়লাম। সারা দিনের ক্লান্তি শেষে রাজ্যের ঘুম নেমে এলো চোখে। ঘুম ভাঙল আজানের মধুর সুরে। বাইরে থেকে ভেসে আসছে পাখিদের মিষ্টি-মধুর কলতান। জানালা খুলে বাইরে তাকালাম। শহুরে জয়পুর দালানকোঠায় পরিপূর্ণ। যোজন যোজন আকাশচুম্বী প্রাসাদ। কেবল সবুজ ও সতেজ একটি গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে হোটেলের দেয়াল ঘেঁষে। তার ডালে বসেই কিচিরমিচির রবে ডাকছে হাজারো পাখি। অপূর্ব শান্ত-স্নিগ্ধ একটা সকাল। মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠল মুহূর্তেই। ফজরের নামাজ পড়ে ফের কতক্ষণ ঘুমালাম। সকাল ৮টার দিকে তৈরি হয়ে বেরোলাম। সকালের নাশতাটা একটা হোটেলে সেরে হাঁটা ধরলাম প্রধান সড়ক ধরে। সূর্যটা মাথার ওপর জ্বলজ্বল করছে। তীব্র রোদে ঘাম ঝরে পড়ছে কপাল বেয়ে। রাস্তার দু’পাশে রঙিন দালান ও দোকানপাট। দালানগুলো অনেক পুরোনো মনে হলো। হয়তো আগের রাজা-বাদশাহদের তৈরি। অসম্ভবের কিছুই না। মরুময় রাজস্থানের এই জয়পুর শহর একসময় ছিল রাজা-বাদশাহদের আবাসস্থল ও বিনোদনকেন্দ্র। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম অনেকটা পথ। হঠাৎ রাস্তার পাশে দেখলাম ছোট ছোট অনেক জানালাবিশিষ্ট ঐতিহাসিক হাওয়া মহল। ‘বড়ি চৌপদ’ নামে পরিচিত একটি বড় রাস্তার প্রতিচ্ছেদনের উপর অবস্থিত এটি। বাইরে থেকে অসম্ভব সুন্দর দেখতে। সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলে নিলাম। গেইট দিয়ে ভেতর ঢুকতেই দেখলাম লম্বা একটা সিরিয়াল। এখান থেকে টিকিট কেটে ভেতর প্রবেশ করছে সবাই। অন্যদের মতো আমিও গিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। টিকিট প্রতিটি ৫০ রুপি। প্রাসাদটির প্রবেশপথ সামনের দিক দিয়ে নয় বরং পেছনের দিকে। মনের ভেতর রোমাঞ্চ নিয়ে প্রবেশ করলাম। প্রাসাদের সম্মুখভাগ দেখে মনে হয়, যেন এটি কেবল একটি ফ্রেম এবং এর পেছনে কিছুই নেই। মূল মহলের সামনে ছোট্ট একটা চত্বর। ডানপাশে রয়েছে একটি প্রতœতাত্ত্বিক যাদুঘর। কৌতূহলী হয়ে সেখানে প্রবেশ করলাম। কাচের ফ্রেমে বন্দী করে আগের রাজা-বাদশাহদের ব্যবহৃত পুরনো জিনিস রাখা আছে তাতে। ছুরি, তলোয়ার থেকে শুরু করে মাটির তৈরি তৈজসপত্র। দেয়াল ঘেঁষে লাগানো আছে একটা শিলালিপি। হিন্দি ভাষায় লেখা এ মহলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। পড়ে যা জানলাম তা হলো, আগেকার দিনে রাজপরিবারের মেয়েদের সর্বজনের সামনে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। তারা যেন প্রাসাদে বসেই নিকটবর্তী অঞ্চল ও সরণীগুলো পর্যবেক্ষণ করতে পারে ও বাইরের মনোরম বাতাস গায়ে মাখতে পারে তাই ছোট ছোট জানালা রেখে মহারাজা সওয়াই প্রতাপ সিং ১৭৮৮ সালে এটি নির্মাণ করেন। প্রাসাদটিতে ৯৫৩টি পাথরখোদিত জানালা রয়েছে। জানালাগুলো এমনভাবে রাখা হয়েছে যে, বাইরের মানুষ এর ভেতরের কাউকে দেখতে পাবে না, অথচ ভেতরের মানুষ বাইরের সব দেখতে পাবে। জানালাগুলো দিয়ে অহর্নিশ শীতল বাতাস বয়ে চলে। পাঁচতলা বিশিষ্ট এ প্রাসাদের উপরের তিনটি তলা কেবল একটি করে কক্ষের সমন্বয়ে গঠিত। প্রাসাদটির নিচে রয়েছে দুটি আঙ্গিনা। সম্মুখভাগে অর্ধ-অষ্টকোণী কুলুঙ্গি, কলস এবং গম্বুজ ও বেলেপাথরে তৈরি উৎকীর্ণ ঝাঁঝরির সঙ্গে সুশোভিত রয়েছে। জয়পুরের অন্যান্য স্মৃতিস্তম্ভের মতো এ রাজপ্রাসাদটিও গোলাপি ও লাল বর্ণের পাথর দিয়ে নির্মিত।
আমরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে চললাম। সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছতে হাঁপিয়ে উঠলাম। মাঝে মধ্যে ছোট জানালার সামনে বসে শীতল হওয়া উপভোগ করে নিলাম মনভরে। শিরশিরে ঠাণ্ডা বাতাস প্রবেশ করছে প্রতিটি জানালার ফাঁক গলে। দেশ-বিদেশের হাজারো পর্যটক এসেছেন বেড়াতে। তাদের সাথে ঘুরে দেখলাম চারপাশটা। দূরের পাহাড়গুলোর সৌন্দর্য মুগ্ধ করল সবাইকে। নিচে নেমে ছুটলাম আরেক বিস্ময় দেখতে। রাজপথের ফুটপাথ ধরে দক্ষিণ দিকে এগোতে লাগলাম। মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর এক গলি পেরোতেই পড়ল ‘যন্তর-মন্তর’ গেইট। এখানেও টিকিটের জন্য লম্বা লাইন। লাইনে দাঁড়িয়ে একজন থেকে জেনে নিলাম এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
‘যন্তর-মন্তর’ হলো জ্যোতির্বিজ্ঞানের যন্ত্র স্থাপত্যের সমষ্টি। মোগল শাসনের শেষের দিকে ১৭২৭ থেকে ১৭৩৪ সালের মধ্যযর্তী সময় মহারাজা দ্বিতীয় জয়সিংহ জয়পুরে ‘যন্তর-মন্তর’ নির্মাণ করেন। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান ও অঙ্ক শাস্ত্রে বেশ পারদর্শী ও আগ্রহী ছিলেন। শখের বসে তিনি এর মতো আরো পাঁচটা স্থাপত্য নির্মাণ করেছিলেন। সেগুলো অন্যান্য স্থানে অবস্থিত।
টিকিট নিয়ে ভেতর প্রবেশ করলাম। ‘যন্তর-মন্তরের স্তম্ভগুলোর লব্ধ বিষয় সবার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। সে জন্য প্রবেশ পথেই টিভি সিস্টেমে সবকিছু বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায়। দাঁড়িয়ে কতক্ষণ চেষ্টা করলাম বুঝতে। পুরোপুরি না হলেও কিছুটা ধারণা পেলাম ‘যন্তর-মন্তর’ সম্বন্ধে। সামনে এগিয়ে গেলাম। একের পর এক স্তম্ভ ও স্থাপনা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। একেকটির একেক বৈশিষ্ট্য। কোনোটি চন্দ্র-সূর্যের হিসাব নির্ধারণের জন্য, কোনোটি মাস গণনার জন্য, কোনোটি সময় ও দ্বিপ্রহর নির্ধারণ করার জন্য, কোনোটি আমাবস্যা বা পূর্ণিমা নির্ধারণের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। তখনকার সময়ে আধুনিক যুগের মতো দিন, মাস, সময় ইত্যাদি নির্ণয়ের কোনো যন্ত্রপাতি না থাকায় তৈরি করা হয় এ বিস্ময়কর স্থাপনা। বিদেশী পর্যটকেরাও বিজ্ঞানের অপূর্ব সৃষ্টি দেখে বেশ অভিভূত।
একটা অটোতে চড়ে রওনা হলাম ‘জলমহল’ দেখার উদ্দেশ্যে। ২০ মিনিট পর পৌঁছলাম জলমহলের পাড়ে। এখানে টিকিট কাটার ঝামেলা নেই। দু’পাহাড়ের মাঝখানে হ্রদের মতো বিশাল এলাকা জুড়ে টলটলে পরিষ্কার পানির জলাশয়। জলাশয়ের ঠিক মাঝ বরাবর চিত্তাকর্ষক একটি বড় প্রাসাদ। এর নামই জলমহল। পরিষ্কার পানিতে মহলের অসম্ভব মোহনীয় ছায়াও পড়েছে। দু’পাশের পাহাড়গুলো সুন্দর এ প্রাসাটির সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। পানিতে নামার বা প্রাসাদে যাওয়ার অনুমতি নেই কারোর। দূর থেকেই দেখতে হয় এটি। স্বচ্ছ পানিতে ছোটাছুটি করছে নানা জাতের মাছ। দর্শনার্থীরা খাবার কিনে মাছের দিকে ছুড়ে মারছে। লুটোপুটি করে মাছগুলো খেয়ে সাবাড় করছে খাবারগুলো। বেশ কয়েকটি পানকৌড়ি ও বড় বক নজরে পড়ল। নির্বিঘেœ তারা বিচরণ করছে পুরো জলাশয়ে। স্থানীয় একজন থেকে জেনে নিলাম জলমহলের কথা। ১৬১০ সালের কথা। হঠাৎ করে চরম খরা আর দুর্ভিক্ষ দেখা দিলো জয়পুরে। রাজ্যের সব পানি শুকিয়ে গেল। প্রজাদের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে দ্রুত বারবতী নদীতে বাঁধ দিয়ে পানির ব্যবস্থা করেন তখনকার রাজা মান সিং। তৈরি হয় মান সাগর। এরপর বহু বছর ধরে ছোট্ট এই সাগরের পানি মানুষের পিপাসা মিটিয়েছে। এর ২০০ বছর পর আঠারো শতকে তখনকার রাজা মাধু সিং হাঁস শিকারের উদ্দেশ্যে জলাশয়ের মাঝখানে নির্মাণ করেন পাঁচতলা বিশিষ্ট এই জলমহল।
জলমহলে অপূর্ব সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে এলো প্রায়। ফিরতি টিকিট আগেই কাটা ছিল। দেরি না করে রওনা হলাম স্টেশনে। যথাসময়ে ট্রেনে চড়ে ছুটলাম নিজ গন্তব্যে।


আরো সংবাদ



premium cement
ডিএমপির অভিযানে গ্রেফতার ৩৭ বাংলাদেশে নতুন করে বাড়ছে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা হিট অ্যালার্ট নিয়ে আবহাওয়া অধিদফতরের নতুন বার্তা ভান্ডারিয়ায় পিকআপ চাপায় বৃদ্ধ নিহত হোচট খেল লিভারপুল, পিছিয়ে গেল শিরোপা দৌড়ে যোদ্ধাদের দেখতে প্রকাশ্যে এলেন হামাস নেতা সিনওয়ার! ফের পন্থ ঝড়, ঘরের মাঠে গুজরাটকে হারাল দিল্লি ইউক্রেনকে গোপনে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র গ্রেফতারের পর যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনপন্থীদের বিক্ষোভ আরো বেড়েছে ইউক্রেন যুদ্ধে দুর্নীতি, পুতিনের নির্দেশে গ্রেফতার রুশ উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী!  আমেরিকানরা কি ধর্ম থেকে সরে যাচ্ছে?

সকল