১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তার আসার কথা ছিল : জীবনের বাঁকে বাঁকে

-

চশমা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। চশমাটার ফ্রেম চেঞ্জ করলেও পারতাম, তবুও নতুন একটা ফ্রেম পছন্দ হওয়ায় সেটাই কিনলাম। চশমার গ্লাসে কোম্পানির নামের সিল দেয়া। কী এক মেডিসিন দিয়ে সেটা তুলছেন দোকানদার। আমি বাইরে এসে বাজারে জনস্রোত দেখছি। মানুষ আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় দেখার বস্তু। আমি মানুষ দেখতে ভালোবাসি। আতাতুর্ক স্কুল মার্কেটের সামনের জায়গাটায় একটা ভ্রাম্যমাণ দোকানে ভাঁপাপিঠা বানানো হচ্ছে। যে লোকটা বানাচ্ছেন তার পেছনে এক বৃদ্ধা লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নিজের হাতের দিকে তাকালেন, তারপর পা বাড়ালেন।
আমি মহিলাটিকে চিনতে পেরেছি। ইসহাক মার্কেটে আমার দোকান থাকা অবস্থায় প্রায়ই যেতেন। আমি তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করতাম সাধ্যমতো। ভিক্ষা করা প্রতিটি মানুষকে টাকা দিয়ে তৃপ্তি পাওয়া যায় না। এই লাইনে চিটার-বাটপারে ভরে গেছে। তবে এই মহিলাটিকে দেখেই আমার অসহায় মনে হতো। প্রতি দুইদিন পর এলে একটা ১০ টাকার নোট হাতে দিলে কী যে খুশি হতেন! ঈদের সময় তার একটা ছোট নাতিকে নিয়ে আসতেন। তাকে প্রতি ঈদে জামা দিতাম। এই দেয়ায় এক আলাদা তৃপ্তি আছে। আমি না থাকলেও দোকানে নিয়মিত থাকা ছোট ভাই নোমানকে এই নির্দেশ দেয়া আছে।
দোকান ছেড়েছি আজ দুই বছর। এই দুই বছর এই এলাকায় থেকেও অনেকটা বাজারবিমুখ আমি। খুব একটা দরকার ছাড়া আসি না। আমি মহিলাটির সামনে এগিয়ে গেলাম। একটা এক শ’ টাকার নোট এগিয়ে ধরার সাথে সাথে বৃদ্ধা মহিলাটি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। হাত যেন বাড়াতে পারছেন না। খুব ধীরে হাত তুলছেন। হয়তো বিশ্বাস করছেন না যে, কেউ তাকে এক শ’ টাকার নোট দিতে পারে! আমি বললাম, আমাকে চিনতে পেরেছেন? ইসহাক মার্কেটের দিকে ইশারা করে দেখিয়ে বললাম, ওই মার্কেটের দোতলায় আমার দোকান ছিল। সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই সেটা। এবার বাম হাত দিয়ে আমার পিঠ জড়িয়ে ধরলেন। চোখে জল ছলছল করছিল তার। বললাম, অনেকদিন আপনাকে টাকা দেয়া হয়নি তাই এক শ’ দিলাম। হিসাবে তো আরো বেশি পান। কানে কম শুনছেন বলে একটু জোরে বলছি আমি। মহিলা এক অদ্ভুত আনন্দের হাসি দিলেন আমার দিকে তাকিয়ে। আমি বৃদ্ধা মহিলাটাকে নিয়ে ভাঁপা পিঠা দোকানের সামনে গেলাম। বললাম, ভাঁপা পিঠা খাবো কী বলেন? ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ধীরে ধীরে আমার দেয়া এক শ’ টাকার নোটটা উঁচিয়ে বললেন, আমার কাছে টাকা আছে তো দাদু ভাই। আমি হাসলাম। বৃদ্ধার চোখের কোণ বেয়ে জল নামছে। এই জল আনন্দের না কষ্টের তা জানি না। চোখের জলের ভাষা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই।
^^^^^^^^^^একটা পিঠা পুরো খেতে পারলেন না। দুইটা পিঠা একটা প্যাকেটে দিয়ে জানতে চাইলাম,
সামনে তো ঈদ। একটা শাড়ি কিনে দেবো?
- নাহ, আজ না। আরো পরে।
- আজ সমস্যা কী?
- নাহ, এত টেকা খরচা করা ঠিক হইব না আপনের।
- আরে কী বলেন! আপনাকে আবার কখন পাই!
- পাইবেন দাদু ভাই। আগামী জুম্মাবারে আমি এই সময়ে আসুম। তখন কিন্না দিয়েন।
আমি তার কথা মানলাম না। সামনের মার্কেট থেকে একটা শাড়ি কিনে দিলাম। বারবার না বললেও খুব খুশি হয়েছেন এই লাল শাড়ি পেয়ে। আশপাশে দাঁড়িয়ে মানুষগুলো কী যেন তামাশা দেখছে। আমরা নিজেদের এমন দায়িত্বের কাজগুলো না করতে করতে এই স্বাভাবিক কাজকে অস্বাভাবিক মনে করি। সবাই তাই এই সাধারণ কাজকে অসাধারণ মনে করে তাকিয়ে থেকে লজ্জায় ফেলে দেয়।
শাড়ির প্যাকেট হাতে দিয়ে বললাম,
আগামী জুমাবার আসবেন বলেছেন না?
- হ, কইছিলাম।
- সেদিন এই শাড়ি পরে আসবেন। এই ছেঁড়াটা পরবেন না।
- এইটা না ঈদের শাড়ি কইলা দাদুভাই?
- বাঁচলে ঈদ দেখা যাবে।
-হাহা, বাঁচুম না ক্যান? আল্লায় কষ্টে থাকইন্না মাইনষেরে বেশিদিন বাঁচায়া রাখে।
বৃদ্ধা ধীরে ধীরে চলে গেল। বারবার পেছনে ফিরে তাকায়। সেই তাকানোয় কতটা মায়া!
শুক্রবারে জুমার পর বাজারে জিরো পয়েন্টে রাসেদের দোকানে চা খাচ্ছি আমি আর রাজু। সাথে মিজান ভাই এসে যোগ দিলেন। জুমার পর থেকেই আমি এদিক সেদিক তাকাচ্ছি। আতাতুর্ক স্কুল মার্কেটের সামনের দিকে চোখ রাখছি। বৃদ্ধা আজ আসার কথা। এই সময়েই আসবেন তিনি। আর এলে এই মার্কেটের সামনেই থাকবেন তা আমার জানা।
আসরের আজান হয়ে যাবে। সূর্যের প্রখরতা কমেনি মোটেও। ভাবলাম মহিলাটির জন্যে একটা শাড়ি কিনে শিক্ষা বিপণীতে রেখে যাই। মহিলা এলে মানিক ভাই দিয়ে দেবে। এই কথা মাথায় নিয়ে মার্কেটের দিকে এগুচ্ছি। সারা মার্কেটের লোকজন উল্টো দিকে দৌড়াতে শুরু করল। কেউ কেউ আমার সাথে ধাক্কা খেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে দৌড়াচ্ছে। আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম হাজার মানুষ একত্র হয়ে গেল মুহূর্তে। আমি কাছে গেলাম। মানুষ কিছু সরে যাচ্ছে এবার। দেখার জন্যেই এসেছিল, দেখা শেষ চলে যাচ্ছে।
আমি কাছে গিয়ে আশ্চর্য হলাম। সারা শরীরের রক্তগুলোর চলাচল কয়েক সেকেন্ডের জন্যে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। সারা শরীরে অদ্ভুত ঠাণ্ডা লেগে ওঠে, যেন ঘুরে পড়ে যাব। আমার সামনে একটি বৃদ্ধার মাথা থেঁতলে যাওয়া লাশ। চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। গায়ের লাল শাড়িটা দেখে তাকে চিনতে পারলাম। যেই শাড়িটা আমি কিনে দিয়েছিলাম। রক্তের রঙ লেগে সেই শাড়িটা আরো লাল হয়ে আছে। আমি তার লাশ দেখতে এলাম। অথচ সে আমার কাছে আসতে চেয়েছিল।
দাগনভূঁইয়া, ফেনী


আরো সংবাদ



premium cement
ইরানের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে পাশ্চাত্যের দেশগুলো সিদ্ধিরগঞ্জে দুর্ধর্ষ ডাকাতি, নগদ টাকাসহ ৮০ লাখ টাকার মালামাল লুট প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনীর উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী পরীমণির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার আবেদন স্থায়ী যুদ্ধবিরতি না হওয়ায় গাজায় মানবিক প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ : রাশিয়া পিকআপচালককে হত্যা করে রেললাইনে লাশ ফেল গেল দুর্বৃত্তরা এক মাস না যেতেই ভেঙে গেলো রাজকীয় বিয়ে! ইউক্রেনে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত ১৭ নোয়াখালীতে মেলায় সংর্ঘষ নিহত ১ কবরস্থান থেকে বৃদ্ধার বস্তাবন্দি লাশের রহস্য উন্মোচন : পুত্রবধূ ও নাতনি গ্রেফতার মিরসরাইয়ে বজ্রপাতে কৃষকের তিন গরুর মৃত্যু

সকল