২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হাত বাড়িয়ে দিই

জীবনের বাঁকে বাঁকে
-


আমার বাসার ম্যানেজার (ছুটা বুয়া), হালিমা ঈদের আগের দিন কাজ করে যাওয়ার সময় জানায়Ñ
আপা কাল বিকেলে (ঈদের দিন বিকেলে) বড় জামাতাসহ (মেয়ের জামাই) বাড়ি যাবো, চার-পাঁচ দিন পর আসব।
ঈদের তিন-চার দিন আগেই হালিমার মেয়ে সন্তানদের নিয়ে গ্রামে চলে যায়। হালিমা আর ওর মেয়ে কয়েক বাসায় ছুটা কাজ করে, ওদের স্বামীরা বাড়ির দারোয়ানের কাজ করে। ঈদের তিন দিন পর আমি নিজেই কল করিÑ
কবে আসবে তোমরা?
আপা পারভেজের (ছোট নাতি) হাত ভেঙে গেছে আসতে ৩-৪ দিন দেরি হবে।
ডাক্তার দেখাইছি, একটু ভালো হলেই আসব।
আমি আর কথা বাড়াইনি। চার দিন পর আবার কল করিÑ
কবে আসবে তোমরা?
আপা আর মাত্র দু’দিন পরই আসছি, ওদের নিয়ে একসাথেই আসব।
হালিমা এলো কাজে যোগ দিলো। দুই দিন পর ৬ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার এসে বলেÑ
পারভেজ পড়ে গিয়ে আবার হাতে ব্যথা পেয়েছে।
প্লাস্টার করোনি হাত।
না, দেশে কবিরাজে কী কী দিয়ে বাইন্ধা দিছে, আসার আগের দিন খুলে আইছি।
খুব করে বকা দেই কবিরাজের কথা শুনে, ছেলেটার বয়স চার বছর। বললামÑ
ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাও, পঙ্গু হাসপাতাল যেতে পারো, ডাক্তার দেখিয়ে প্লাস্টার করাও।
তখন দুপুর, নিজের কিছু কাজের ব্যস্ততা। পাশের প্রাইভেট হাসপাতালের কথা বলি কী করে, গেলেই গলায় পোচ দিয়ে হাজার কয়েক টাকা নিয়ে যাবে।
তবুও বিকেলে পারভেজকে নিয়ে ওর মা আম্বিয়া যায় প্রাইভেট হাসপাতালে। ডাক্তার এক হাজার টাকা ভিজিট চাইল। বলল, এক্সরে করাতে হবে, তা দেখে চিকিৎসা করাতে হবে। ভিজিট এক হাজার, এক্সরে ৪০০ টাকা। এর পরের চিকিৎসা খরচ তো আর আগে বলা যাচ্ছে না। ওরা ফিরে আসে। শুক্রবার সকালে আমাকে জানায়। আমিও জানি ডাক্তার দেখানো ছাড়া অর্থাৎ প্রেসক্রিপশন ছাড়া এক্সরে করায় না। নিজের সততা সাহস আর নীতিকে সম্বল করে দুপুরে প্রাইভেট হাসপাতালে যাই ওদের নিয়ে। এক্সরে করাতে বললে বলেÑ
প্রেসক্রিপশন কোথায়?
নেই।
তাহলে তো করা যাবে না, প্রেসক্রিপশন নিয়ে আসেন।
কল করি ভাইয়ের বউকে, সে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। ওকে না পেয়ে কল করি বোনের হাসব্যান্ডকে। তাকে বিষয়টি বলি, ভাইয়াকে দিয়ে হাসপাতালের লোকের সাথে কথা বলিয়ে দিই। ভাইয়া নিজের পরিচয় নাম সব বলে এক্সরের কথা বলে। ভাইয়াও সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। দিলাম এক্সরে করতে, লাগবে ৪০০ টাকা। কমিশন দিতে বলে ৩০০ টাকায় করালাম। এক্সরের ফিল্ম দেখে তো আমার চোখ ওপরে। মানুষের হাতের কনুই ও কব্জির মাঝখানটুকুতে দুটো মোটা হাড় থাকে। একটি হাড় ভেঙেছে। হাড়ের উপরে হাড় উঠে আছে। আম্বিয়াকেও দেখালাম। শুক্রবার বলে আজ রিপোর্ট দেবে না, বলল শনিবার বিকেলে দেবে।
এ ফাঁকে একটুখোঁজ নিলাম হাড়ের ডাক্তারের, ভিজিট ছাড়া যদি ডাক্তার দেখাতে পারি। যতটুকু শুনলাম নিরাশ হওয়ারই কথা। মনে পড়ে দুই বছর আগে আমার নিজের বাম পা ভাঙার পর এক ডাক্তারকে দেখাই। যতটা মনে পড়ে ভিজিট এক্সরে আর প্লাস্টার মিলিয়ে ছয়-সাত হাজার টাকা গেছে। যদি আমার প্লাস্টার করতে ৬টি ব্যান্ডেজ লেগে থাকে, পারভেজের প্লাস্টার করতে লাগবে মাত্র একটি ব্যান্ডেজ। অবশ্য প্লাস্টার করতে হবে কি না তাও জানি না।
শনিবার বিকেলে রিপোর্ট নিয়ে আসা হয়।
বিকেলে বাংলা একাডেমির একটা প্রোগ্রামে অংশ নিয়ে দ্রুত সন্ধ্যা ৭টায় পারভেজকে নিয়ে যাই প্রাইভেট হাসপাতালে। আমার জানা মতে, দু’জন ডাক্তার আছেন হাড়ের। আমার পা ভাঙার পর যাকে দেখাই তার চেম্বারের সামনেই যাই। চেম্বারের সামনে বসা সহকারীকে বলিÑ
আমি একটু ভেতরে যাবো, ডাক্তারের সাথে কথা আছে।
যেতে পারবেন সিরিয়াল নিন, ভিজিট দিয়ে টোকেন নিন।
আমি ভিজিট ছাড়াই দেখাব, রোগী আমি নই, একটা অসহায় পরিবারের ছোট শিশুকে দেখাব। ডাক্তার কথা শুনে যদি বলেন তিনি দেখবেন, তাহলে দেখাব, না হয় কালকেই পঙ্গু হাসপাতাল যাবো।
আপনি ভিজিট দিয়ে টোকেন নিয়ে ভেতরে যান, স্যার বললে ভিজিট ফেরত দেবো।
আমি তাতে রাজি হইনি। কারণ টাকা এমন জিনিস পকেট থেকে বেরিয়ে গেলে তাকে আবার ঢুকানো সম্ভব হয় না।
আপনি আমায় ভেতরে যেতে না দিলে আমি জোর করেই যাবো, পরিস্থিতি খারাপ হলে আপনারা দায়ী থাকবেন।
তারা রাজি হলেন ভেতরে যেতে দেবেন। তখনো ভাবনা, আমি যেন পজেটিভ কিছুই করতে পারি। ভেতরে যাওয়ার সুযোগ পেলাম, ডাক্তার আমায় দেখেই চিনতে পারেন। তাকে সব বুঝিয়ে বলি। সব শুনে তিনি বললেন, প্লাস্টার করার দরকার নেই, ভাঙার ১৫ দিন হয়ে গেছে। যেভাবে জোড়া লাগছে ঠিক হয়ে যাবে। কিছু ওষুধ খেতে হবে আর হাতটা গলার সাথে ঝুলিয়ে রাখতে হবে।
বাসায় ফিরলেও মনে শান্তি নেই। পারভেজের বাবার কথাÑ
নানার বাড়ি গেছে বলেই তো হাত ভেঙেছে। না গেলে ভাঙত না।
এটি আমাদের সমাজব্যবস্থার একটি সত্য রূপ। যাক এ বিষয়ে লিখব পরে। রাত, চোখে ঘুম নেই। হাতটা ঠিক হবে তো।
সকালে সব ব্যবস্থা করে পঙ্গুতে পাঠাই ওদের। আমার সমস্যার জন্য যেতে পারিনি। পঙ্গু হাসপাতালের ডাক্তার দেখে বলেনÑ
কে বলছে প্লাস্টার করা লাগবে না।
আমার ম্যাডাম এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে তিনি বলেছেন। (ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ওদের সাথে ছিল)
আপনার ম্যাডামকে বলবেন, হাসপাতাল গিয়ে ডাক্তারকে যেন দুইটা চড় মেরে আসে।
সকাল ৭টায় গিয়ে বেলা ১১টায় ওরা আসে। এর মাঝে কয়েকবার যোগাযোগ হয় আমার ওদের সাথে। ডাক্তার বলেছেন ১৫ দিন এভাবে প্লাস্টার থাকবে। ১৫ দিন পর আবার যেতে। রমজান মাসে আমরা জাকাত ও ফেতরা দিই। এখন রমজান মাস নয়। তবুও সামনের বছরের জাকাতের টাকা ধরে পারভেজের এই হাত ভাঙার খরচ আমিই দিলাম। আমি শুনেছি রমজানের আগেও এমন করে অগ্রিম জাকাতের টাকা দেয়া যায়। দোয়া করবেন সবাই পারভেজের জন্য। আসুন আমরা টাকা দিয়ে না পারলেও পরামর্শ ও একটু শ্রম দিয়ে ওদের পাশে দাঁড়াই। হাতটা বাড়িয়ে দিই মমতায়।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement