১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কেউ কারো নয়

চারাগল্প
-

কুয়াশা ঢাকা শীতের সকাল। ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন চার দিক। সামনে থাকা একটু দূরের বস্তুকেও ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না। বাইরে শিরশির করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। প্রচণ্ড শীত। মনে হয় আজ আর সূর্য উঠবে না। এত শীতের মধ্যেও আসলাম সাহেব শুধু একটি পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে দিলারা বেগমের লাশের পাশে বসে আছেন। গতরাতে, রাত ৩টায় দিলারা বেগম অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি তাড়াহুড়ো করে একটি পাঞ্জাবি পড়েই জীবন সঙ্গিনীকে নিয়ে হসপিটালে ছুটে এসেছেন। আসলাম সাহেবের মুখে কোনো আহাজারি নেই। তার চোখ দিয়ে কেবল বেদনাশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। এত দিনের জীবন সঙ্গিনীকে হারিয়ে তিনি আজ বাকরুদ্ধ। আসলাম সাহেবের বয়স ৯০ ছুঁই ছুঁই। তবুও দিলারা বেগমের প্রতি তার ভালোবাসার কোনো ঘাটতি নেই। এ বয়সেও দু’জন-দু’জনকে অকৃত্রিম ভালোবাসায় জড়িয়ে রেখেছিলেন। তারা দু’জন-দু’জনকে ছাড়া এক মুহূর্ত কাটাননি। যে যেখানেই থাকুক রাতের খাবার তারা দু’জন একসাথে খেয়েছেন। কিন্তু আজ থেকে তিনি কী করবেন? এ বয়সে কে তার সেবা করবেন? হাজারো কষ্টের মাঝে কে এখন সান্ত্বনার বাণী শোনাবেন? প্রশ্নগুলো তীরের মতো বিগ্ধ হচ্ছে তার অন্তরে। কিন্তু প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। দিলারা বেগমের লাশের দিকে চেয়ে তিনি ভাবছেন আর নীরবেই অশ্রু ফেলছেন। এমন সময় হসপিটাল কর্তৃপরে একজন এসে বললেনÑ ‘চাচা লাশটি দ্রুত নিয়ে যান’।
এই প্রথম দিলারা বেগমের মৃতদেহটাকে লাশ হিসেবে সাব্যস্ত করলেন।
হসপিটাল কর্তৃপরে কথা শুনে তিনি মনে একটু আঘাত পেলেন। তবুও বললেন,
প্লিজ একটু সময় দিন। আমি বৃদ্ধ মানুষ। একা একা নিয়ে যেতে পারব না। আমার ছেলেমেয়েরা এখনই এসে পড়বে।
এবার লোকটি একটু রাগের স্বরেই বললেন,
- এখনো ছেলেমেয়েরা আসেনি? রাতে রোগীকে গ্রাম থেকে একা একা কিভাবে এনেছিলেন?
- গ্রামের একজনের অটোরিকশা ভাড়া করে এনেছিলাম।
- অটোরিকশাওয়ালা কি চলে গেছেন?
- হ্যাঁ।
-আপনার ছেলেমেয়েরা আসেননি কেন?
-ওরা ঢাকায় চাকরি করে।
-তাহলে তো আপনারা ছেলেমেয়ের কাছেই থাকতে পারতেন। গ্রামে কেন একা পড়ে আছেন? এ বয়সে কী একা একা থাকা যায়?
এ প্রশ্নের প্রতি-উত্তর খুঁজে পান না আসলাম সাহেব। কী বলবেন তিনি? এ বয়সে একা একা থাকতে আসলাম সাহেবেরও ভালো লাগে না। এ বয়সে ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনী কাছে থাকলে হেসেখেলে জীবনটা পাড়ি দেয়া যেত। অনেক স্বপ্ন নিয়ে তিনি ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছেন। নিজের ঘাম ঝরানো উপার্জিত অর্থ খরচ করে ছেলেমেয়েকে উচ্চশিায় শিতি করেছেন। ছেলেমেয়েরা আজ প্রতিষ্ঠিত। এক ছেলে ও এক মেয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। একটি ছেলে কাস্টমস অফিসার। সবাই বিবাহিত। তারা ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি করেছেন। নানি-নাতনী নিয়ে তারা হেসেখেলে জীবন পার করছেন। আসলাম সাহেব ও দিলারা বেগম গ্রামের জমিজমা বর্গা দিয়ে, ছেলেমেয়েদের কাছে থাকার জন্য একবার ঢাকায় গিয়েছিলেন। কিন্তু থাকতে পারেননি। ছেলেবউ ও মেয়েজামাতাদের আচরণ তাদের কাছে কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল। কেন যেন নিজেদের দাসদাসী মনে হতো। যে শান্তির জন্য তারা ঢাকায় এসেছিলেন, সেই শান্তির বদলে অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছিল সংসারে। তাই বেশি দিন তারা থাকতে পারেননি। চলে এসেছিলেন গ্রামে। সেই থেকে তারা সুখে দুঃখে গ্রামে থেকেই ছেলেমেয়েদের মঙ্গল কামনা করতেন।
প্রায় ১০টা বেজে গেল। ছেলেমেয়ে কেউ এখনো আসেনি। আসলাম সাহেব ছেলের সাথে ফোনে কথা বললেন,
বাবা তোমরা কোথায়? ১০টা তো বেজে গেল। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তোমার মায়ের লাশকে দাফন-কাফন করতে হবে তো।
অপরপ্রান্ত থেকে ছেলে বললেন,
- বাবা আমরা এখনো রাস্তায় আছি। ঘন কুয়াশায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। হাইস্পিডে গাড়ি চালানো যাচ্ছে না। হসপিটালে পৌঁছতে আমাদের আরো দুই ঘণ্টা লাগবে। তুমি একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে মায়ের লাশটি দ্রুত বাড়িতে নেয়ার ব্যবস্থা করো। আমরা সরাসরি বাড়িতেই যাচ্ছি।
ছেলের কথা শুনে আসলাম সাহেব কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কী করবেন তিনি? কোথায় পাবেন অ্যাম্বুলেন্স? তা ছাড়া লাশের পাশে কে থাকবে? অল্পশিতি আসলাম সাহেব এ শহরের তেমন কিছুই চেনেন না। কিভাবে সামলে নেবেন এ কাজটি? এ অবস্থায় নিজেকে আনফিট মনে হচ্ছে তার। ছেলেমেয়ের ওপর একটু ভরসা করে তিনি বসেছিলেন এতণ। কিন্তু ছেলেমেয়েরা এ বৃদ্ধ বয়সেও দায়িত্বটা তাকেই দিয়ে দিলো। তিনি বুঝলেন, এ দুনিয়ায় কেউ কারো নয়। বুক ফেটে কান্না আসছে আসলাম সাহেবের। মনে হচ্ছে, চিৎকার করে কিছুণ কান্না করলে তিনি স্বস্তি পাবেন। কিন্তু এখানে সেটারও তো কোনো উপায় নেই। হঠাৎ করে আসলাম সাহেবের শরীরটা থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। মাথাটাও অস্বাভাবিকভাবে ঘুরতে লাগল। বোঁ-বোঁ করে ঘুরছে মাথাটা। সব ভাবনার ইতি টেনে একসময় তিনি দিলারা বেগমের লাশের ওপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।
সান্তাহার, বগুড়া


আরো সংবাদ



premium cement