২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

আজমির শরিফে একবেলা

-


আশুরার ছুটি পেলাম চার দিন। পাঁচ বন্ধু পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলাম রাজস্থান সফরে বেরোব। আজমির শরিফ ও জয়পুরের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখার ইচ্ছে মনে পোষণ করছিলাম বহুদিন ধরে। এবার সে সুযোগটা এলো। রিজার্ভেশন বগিতে টিকিট কেটে ভোর ৪টায় ট্রেনে চড়লাম। সিট নিলাম জানালার পাশে। হুইসেল বাজিয়ে গাড়ি একসময় চলতে শুরু করল ফসলি মাঠের মধ্য দিয়ে। তখনো রাতের আঁধার চার পাশে। পূর্ব দিগন্ত ফর্সা হতে শুরু করেছে আস্তে আস্তে। দিগন্তজোড়া মাঠ। যত দূর চোখ যায় তত দূর। যেন তার শেষ নেই। সুবহে সাদিকের শুভ্র আভা চার পাশ আলোকিত করে তুলছে ক্রমেই। ঝকঝক শব্দ আলোআঁধারির নীরবতা ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে অনেকদূর পর্যন্ত।
একটু পর পুবআকাশে রক্তিম সূর্য উঁকি দিলো। সব আঁধার দূর হয়ে নেমে এলো সকালের কোমল আলো। সে আলোয় দেখতে লাগলাম মহান রবের অপূর্ব সব সৃষ্টি। শরতের ভোর। নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশ চার পাশে। ট্রেনের জানালা গলে ছুটে আসছে এলোমেলো স্নিগ্ধ বাতাস। বাইরের এমন মনকাড়া দৃশ্য দেখতে দেখতে সময় পার করছিলাম।
রাজস্থান প্রবেশের পর দেখা মিলল সারি সারি পাহাড় ও পর্বতের। যেন আকাশ ছুঁয়েছে। মহান আল্লাহর অপূর্ব আর বিস্ময়কর সৃষ্টি পাহাড়। দেখে চোখ জুড়িয়ে এলো।
যখন আজমির স্টেশনে নামলাম, তখন বেলা ১টা। প্রথমেই পরদিনের ফিরতি টিকিট কেটে নিলাম। একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে রওনা হলাম মাজারে। ট্যাক্সি ড্রাইভার এখানের স্থানীয়। মাজারের ইতিহাস সম্পর্কে টুকটাক জানলাম তার থেকে।
১৯৫০ সালে আজমির শহরটি ভারতের একটি রাজ্য হিসেবে মর্যাদা লাভ করলেও ১৯৫৬ সালে এটি রাজস্থানের সঙ্গে একীভূত হয়। আজমির শহর রাজস্থানের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত। খাজা মইনুদ্দিন চিশতি রহ:-এর কবরকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে এ মাজার। ভারত তো বটেই, বিদেশ থেকেও অনেক মানুষ আসে এখানে। খাজা মইনুদ্দিন চিশতি রহ: ১১৪২ সালে ইরানে জন্মগ্রহণ করেন। ১১৯২ সালে মোহাম্মদ ঘোরির সঙ্গে ভারতে আগমন করেন। এসে তিনি আজমিরের ৮০০ ফুট উঁচু এক পাহাড়ে আস্তানা গড়ে ইসলাম প্রচারে নিমগ্ন হোন। কোনো বর্ণনা মতে, তিনি সম্রাট আকবরের ধর্মগুরু ছিলেন। তিনি ধর্মকর্মে বাকি জীবনটা বিলিয়ে দিয়েছেন এখানেই। ১২৩৬ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। আজমিরেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়। এরপর সেখানে গড়ে ওঠে প্রসিদ্ধ মাজার আজমির শরিফ। তার মৃত্যু মাসকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর রজব মাসে ঘটা করে পালিত হয় ওরস শরিফ।
ট্যাক্সি থেকে নেমে বিল চুকিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। পর্যটন এলাকা হওয়ায় খাবারের দাম একটু বেশিই। হালকা কিছু খেয়ে রওনা হলাম মাজারে। মাজারের বিশাল গেট। সেখানে নিরাপত্তা দিচ্ছে পুলিশ ও সবুজ কাপড় পরিহিত মাজারের কয়েকজন লোক। জুতা পায়ে প্রবেশ নিষেধ। ব্যাগও নেয়া যায় না সাথে। এক জায়গায় দশ রুপিতে ব্যাগ গচ্ছিত রেখে জুতা হাতে প্রবেশ করলাম মাজারে। ভেতরে নারী-পুরুষের মেলা বসেছে যেন। পায়ে পায়ে এগোলাম সামনে। মাজারটা এখন শিয়াদের দখলে। মাজারের ভেতর ও বাইরে সারি সারি ফুলের দোকান। মাজারে উৎসর্গ করতে ফুল কিনে মাজারে চড়ায় দর্শনার্থীরা। একটু সামনে এগিয়ে দেখলাম দুই পাশে বিশাল দুটি ডেগ। এর চার পাশে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। উৎসুক হয়ে উপরে উঠলাম। দেখলাম, একটাতে মাজারভক্তরা টাকা ফেলছে, অন্যটাতে খাদ্যসামগ্রী। টাকায় প্রায় অর্ধেকটা ভরে গেছে ডেগের। সেখান থেকে নামতেই ডান পাশে একটা লম্বা কক্ষ নজরে পড়ল। ওরসের সময় গানবাজনা শোনার জন্য এখানে অবস্থান করে দর্শনার্থীরা। মূল মাজারে প্রবেশ করতে আরেকটা গেট পেরোতে হয়। গেট পার হলে সাদা গম্বুজের মাজার। গম্বুজের চার পাশে রয়েছে সোনায় মোড়ানো গম্বুজাকৃতির চারটে সিলিং। মাজারের চার পাশে ভক্তদের প্রচুর ভিড়। ভিড় ঠেলে সামনে এগোলাম। মাজারের অপর পাশে মানুষ ফুল চড়াচ্ছে।
মূল মাজারটি ভেলভেটে মোড়া শ্বেত মর্মরের সমাধি বেদি, যা রুপোর রেলিং দিয়ে ঘেরা। পাশেই আছে মইনুদ্দিন চিশতি র:-এর কন্যা ও শাহজাহান কন্যা চিমনি বেগমের সমাধি। ভেতরটা ঘুরে ঘুরে দেখে আর কিছু ওজিফা পাঠ করে বেরিয়ে এলাম মাজার থেকে। মাজারের পাশেই মসজিদ। ১২৩৬ সালে দাস সুলতান ইলতুতমিশ এই মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু করেন। আর শেষ ১৬ শতকে মোগল সম্রাট হুমায়ুনের হাতে। এর প্রবেশদ্বারটি তৈরি করেছিলেন হায়দরাবাদের নিজাম। ১৫৭০-৮০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর আগ্রা থেকে হেঁটে সম্রাট এই দরগায় আসতেন। মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করে বেরিয়ে এলাম বাইরে। মাজারের দক্ষিণ দিকে বিশাল একটি পাহাড়। শুনেছি তার ওপর তারাঘর নামে একটা জায়গা আছে। খুব সুন্দর নাকি জায়গাটি। পাহাড়টিতে চড়ার ইচ্ছে হলো চারজনেরই। বাইরে গিয়ে সেখানে যাওয়ার রাস্তা জিজ্ঞেস করলাম একজনকে। সে জানাল, তারাঘর ছয় কিলোমিটার উপরে। হেঁটে ওঠার সাহস তেমন কেউ করে না। গাড়িতে চড়েই যায় সবাই। আমরা হেঁটে উপরে চড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যতই উপরে উঠছি ততই পাহাড়ের অপূর্ব সৌন্দর্য নজর কাড়ছে। পাহাড়ের গায়ে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি। শক্ত পাথরগুলো হাজার বছর ধরে এভাবেই পাহাড়কে বেষ্টন করে রেখেছে। পাহাড়ের ওপর ছড়িয়ে আছে গাছগাছালি ও বিভিন্ন প্রজাতির গুল্ম। যেন সবুজের নিকুঞ্জ একেকটা। উপরে ওঠার জন্য পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সিঁড়ি বানানো হয়েছে। এগুলো মোগল আমলের তৈরি। সে যুগের প্রতিটি শিল্পশৈলী বিস্ময়কর এবং মুগ্ধকর। কিছুক্ষণ ওঠার পর হাঁপিয়ে উঠি। একটু পরপর পাহাড়ের কোলঘেঁষে রয়েছে দোকান। সেখান থেকে ঠাণ্ডা পানীয় কিনে পান করে ফের চড়তে শুরু করি। এক জায়গায় পড়ল আরেকটি মাজার। এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার চড়তে শুরু করলাম। একেবারে চূড়ায় পৌঁছতে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগল। চূড়ার চার পাশ বিশাল আকৃতির দেয়াল দিয়ে ঘেরা। মোগল আমলে যুদ্ধের সুবিধার্থে নির্মাণ করা হয়েছিল এগুলো। এখন দর্শনীয় স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেখান থেকে নিচে তাকালাম। দুনিয়ার বিস্ময় যেন একসাথে চোখে জড়ো হলো। পুরো আজমির শহর দেখতে পেলাম এখান থেকে। দূরের পাহাড়গুলো খুব কাছের মনে হলো। সবুজে আবৃত পাহাড়গুলোর অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে মুখ ফুটে বেরিয়ে এলো ‘সুবহানাল্লাহ’। নিচের বাড়িঘর অনেক ছোট ছোট মনে হলো। ক্যামেরাবন্দী করে নিলাম পাহাড়ের অপূর্ব সে দৃশ্যপট। জায়গার নাম তারাঘর হলেও সেখানে কোনো তারাঘর নেই। উপর থেকে নিচের রূপটাই দেখতে আসে হাজারো পর্যটক। সন্ধ্যা নামতে বেশি সময় নেই। আশপাশটা ঘুরে ফের হেঁটে রওনা হলাম নিচে। আসার পথে সূর্য ডোবার অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্যে হারিয়ে ছিলাম কতক্ষণ। নিচে নামতে বেশি সময় লাগল না। নামাজ পড়ে হালকা নাস্তা করলাম। স্টেশনে গিয়ে জয়পুরের ট্রেনের অপেক্ষা করতে লাগলাম।


আরো সংবাদ



premium cement
আমরা একটা পরাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছি : মেজর হাফিজ তরুণীর লাশ উদ্ধারের পর প্রেমিকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা ভিয়েনায় মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রদূতদের ইফতারে ইসলামিক রিলিজিয়াস অথোরিটি আমন্ত্রিত এবার বাজারে এলো শাওমির তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ি সকল কাজের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতি থাকতে হবে : মাওলানা হালিম বিএনপি জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি করে : ড. মঈন খান সাজেকে পাহাড়ি খাদে পড়ে মাহিন্দ্রচালক নিহত জমি রেজিস্ট্রি করে না দেয়ায় বাবার কবরে শুয়ে ছেলের প্রতিবাদ ইসরাইলি হামলায় গাজায় আরো ৭১ জন নিহত পানছড়ি উপজেলায় চলমান বাজার বয়কট স্থগিত ঘোষণা আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করেছে : দুদু

সকল