২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

আমার ডান পা : জীবনের বাঁকে বাঁকে

-

১৯৮৬ সাল। তখন আমার শিশুকাল। এক পা দুই পা করে হাঁটতে শেখার বয়স। এক সূর্য উঠা সকালে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়াতেই সর্বপ্রথম আমার ডান পায়ের সমস্যাটা দাদীর চোখে পড়ে। সময় নষ্ট না করে তিনি পায়ের দিকে বিশেষ নজর দিলেন এই কারণে যে, তার এই নাতিই বংশের প্রথম বাতি। তড়িঘড়ি করে ছুটলেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার ভয়াবহ এক সংবাদ জানায়Ñ ‘আপনাদের শিশুর পায়ে পোলিও রোগ।’
এমন নিষ্ঠুর সংবাদ শুনে পরিজনদের মুখে একে একে কালো মেঘের রেখা। সেই কালো মেঘের রেখাকে কঠিন ঝড়ে পরিণত না করে সবাই ছুটলেন আমার ডান পায়ের এই অপ্রত্যাশিত রোগ নিরাময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনায়। প্রবাসী বাবার পাঠানো কষ্টার্জিত পয়সায় দাদী, মা আর নানাজান আমাকে নিয়ে শহরমুখী হলেন, যেখানে নাকি উন্নত চিকিৎসা পাওয়া যায়!
সেই উন্নত চিকিৎসাই পাওয়া গেছে সত্যি, কিন্তু ডানপায়ে চিরতরে রয়ে গেল পোলিও রোগের চিহ্ন। হাঁটলে আমার ডানপায়ে খোঁড়াভাব যে কারোই চোখে পড়ে। শৈশব-কৈশোরের পর তারুণ্যকে সঙ্গে নিয়ে আমার বয়স এখন ৩০ পেরিয়ে। জীবনের ফেলে আসা লম্বা অতীতের বিভিন্ন পর্বে আমি কারো কারো কাছে অবহেলিত হয়েছি ডান পায়ের সমস্যার কারণে। ‘খোঁড়া, লুলা, পঙ্গু’ শব্দের বিষমাখা তীর ছোড়ে কেউ কেউ আমাকে করেছেন নির্মম জখম। এখনো রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে কারো উৎসুক দুটি চোখের নজর পড়ে থাকে আমার ডান পায়ে। হয়তো তারা মনে মনে বলেনÑ ‘আহারে, ছেলেটা তো দেখতে খারাপ না। পা তার দৈহিক সৌন্দর্য নষ্ট করে দিলো।’ এসব ভাবি আর কষ্ট পাই।
কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আমি নিজেকে শতভাগ তুলে ধরতে পারি না। না জানি কেউ আমার পা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কি না! মনে মনে পঙ্গু, ল্যাংড়া, শব্দ জপেন কি না! কিশোরবেলা পেরিয়ে আমি যখন একটা পরিণত বয়সে এলাম, তখন সরাসরি অনেকেই আমার পায়ের সমস্যার প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছি সত্য, কিন্তু প্রতিবার আমি নার্ভাস হয়েছি আর বুকের অতলের গোপন কষ্টগুলোকে জলীয়বাষ্প বানিয়ে মনের সাদা আকাশে উড়িয়ে দিয়েছি। কষ্টগুলো দুঃখ হয়ে মেঘের সাথে মিশে গেছে।
ডান পায়ের এই সমস্যা নিয়ে আজো আমি পথ চলি। আজো প্রতিবেলায় অনেকের জিজ্ঞাসু চোখ তাকিয়ে থাকে আমার ডান পায়ের দিকে। লেখালেখির কারণে অনেক দূরÑদূরান্তের মানুষের সাথে আমার পরিচয় হওয়ার পাশাপাশি কেউ কেউ সরাসরি আমার কাছেও এসেছেন। হেসে হেসে কথা বলার একপর্যায়ে তারা যখন আমার ডান পায়ের সমস্যার প্রশ্ন তোলেন, আমি তখন ভেঙে পড়ি, লজ্জা পাই। এই ভেঙে পড়া আর লজ্জাবিষয়ক অনুভবগুলো আমার কাছে মনে হয় আমার সারা জীবনের স্থায়ী পরাজয়। যত দিন বাঁচব, এই স্থায়ী পরাজয় নিয়েই বাঁচবÑ এই সত্য মেনে নিয়েছি। ফেসবুক আমার সবচেয়ে আস্থার জায়গা। অবিশ্বাস্যভাবে এখানে আমার বিভিন্ন জগতের জ্ঞানী-গুণী মানুষের সাথে আন্তরিক সখ্যতা। ছবি বা সেলফিতে আমার গ্ল্যামার তুলনামূলকভাবে ভালো আসার কারণে খুব সহজে কেউ কেউ আমাকে আপন করে নেন। ফলে সে দায় থেকে তারা তাদের বিভিন্ন প্রোগ্রামে আমাকে ইনভাইটের পাশাপাশি কারণে বা অকারণে দেখা করতে আহ্বান করেন, অথবা সরাসরি আমার কাছেও আসতে চান। আমি খুব কৌশল করে সে আহ্বান এড়িয়ে চলি। তাদের কাছে আমি আমার ডান পা নিয়ে উপহাস পেতে চাই না। ছবিতে আমাকে দেখে তারা যে ফ্যান্টাসি তৈরি করেছেন আমাকে নিয়ে, আমি আসলে সেই ফ্যান্টাসি ভেঙে দিতে চাই না বলে বারবার প্রসঙ্গ পাল্টানোর পথ খুঁজি। এসব কিছুর মধ্য দিয়ে ডান পায়ের খোঁড়া ভাব নিয়ে আমি আমার জীবনের দীর্ঘ একটি সময় পার করে এসেছি।
মন থেকে মাঝে মাঝে সান্ত্বনা আসে, যখন দেখি রাস্তার ধারে পা কাটা ওই পঙ্গু ভিক্ষুক একটি পয়সার জন্য জীবনের কাছে কতই না অসহায়। কল্পনায় যখন তাদের সাথে নিজেকে তুলনা করি, তখন মনে হয় আল্লাহ আমাকে কতই না ভালো রেখেছেন, আলহামদুলিল্লাহ।
রাতের ঘুমে মাঝে মাঝে আমি একটি হুইল চেয়ার স্বপ্নে দেখি। সে হুইল চেয়ারে বসে আছি আমি। আমার ডান পায়ে বোধ নেই, বল-শক্তি নেই। পোলিও রোগ সত্যি সত্যি আমাকে সারা জীবনের জন্য ওই হুইল চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে। আমি কাঁদি তাই একা একা। মাঝে মাঝে সেই একাকিত্ব দূর করে দেয় দুটি স্বপ্নে দেখা কন্যাশিশু। তারা হুইল চেয়ারে বসে থাকা পঙ্গু আমাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যায় রূপকথার গল্পের মতো অচেনা এক পথের দিকে। সে পথ দীর্ঘ। সে দীর্ঘ পথে আমি একা নই। দুটি কন্যাশিশু আছে। ওরা কে! ওরা কি আমার মেয়ে! হ্যাঁ, ওরা আমার মেয়ে। মাথার চুলে লালফিতা দিয়ে ঝুটি বাঁধা আমার মেয়েরা আমাকে হুইল চেয়ারে করে তাদের অভিমানী মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছে।
আজকাল স্বপ্নের এই চিত্রের কথা যতবার ভাবি, ততবার আমার দুটি চোখে বড় সুখে অশ্রু নামে। আমি সুখের সে অশ্রু লুকিয়ে রাখি সহজে। কিছু কিছু সুখের অশ্রু যে কাউকে দেখানোর নিয়ম নেই। কাউকেই না।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।


আরো সংবাদ



premium cement
কারওয়ান বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয় এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত বদরের শিক্ষায় ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : সেলিম উদ্দিন ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু : বিশ্বব্যাংক নোয়াখালীতে ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল কাজ করে যাচ্ছে’

সকল